রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেউ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই পাঠাগারের তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে। মানবাত্মার অমর আলোক কাল অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, একটি পাঠাগার আমাদের সামাজিক জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠাগারের মূল সম্পদ হলো বই। সভ্যতার চাকা এগিয়ে নিতে বইয়ের ভূমিকা অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বইয়ের সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
ঠিক তেমনি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বই পড়ার সুযোগ করে দিতে ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তবর্তী উপজেলা হরিপুরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘অক্সিজেন’ নামের একটি পাঠাগার। পাঠাগারটিতে পাঠকসংখ্যা দিন দিন বাড়লেও বাড়েনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বইসহ ইন্টারনেট সংযোগ। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে প্রয়োজনীয় কম্পিউটার, ইন্টারনেট, টেলিভিশনের মতো মাধ্যমের ব্যবস্থা না থাকায় হতাশ শিক্ষার্থীরা। পাঠাগারের জন্য সরকারিভাবে জমি বরাদ্দ দিয়ে নতুন বইসহ শিক্ষার্থী ও পাঠকদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থার দাবি তাদের।
জানা যায়, ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা একটি উপজেলা ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর। জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। উপজেলা শহর হলেও সন্ধ্যার পরপরই থেমে যায় পথচারীদের চলাচল, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে সারা এলাকা। উপজেলা পরিষদ থেকে ২ কিলোমিটার দূরে বটতলী নামক স্থানে সড়কের পাশে ভাড়া করা জায়গায় গড়ে উঠেছে অক্সিজেন নামের এই পাঠাগার। শিক্ষার আলো, সংস্কৃতির বিকাশ আর উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়া এই এলাকা। স্কুল-কলেজেপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বইমুখী করতে এবং স্থানীয়দের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে একঝাঁক তরুণ গড়ে তুলেছে এই পাঠাগারটি।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে অক্সিজেন জ্ঞানসমৃদ্ধ কেন্দ্রটি ২০২০ সালের ২৬ মার্চ যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে পাঠাগারটিতে ৩ হাজার গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, ভ্রমণ, একাডেমিক বইসহ দৈনিক পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে নিজেদের পাঠ্যবই এবং অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করে। এ ছাড়া পাঠাগারের বিসিএস গাইড, সাধারণ জ্ঞান ও চাকরির পত্রিকা পড়ে এখন পর্যন্ত ১৫ জনের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে।
পাঠাগারের পাঠকদের বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। আবার বই পড়ার টানে অনেকে ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সৌরজগৎ ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন বিষয়ে পর্যাপ্ত বই নেই এখানে। নেই শিশুদের মেধার বিকাশে প্রয়োজনীয় শিশুপাঠ্য। পাঠকদের বসার জন্য পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল ও জায়গার সংকট।
সিরাজুম মনিরা, আরিফুল ইসলামসহ কয়েকজন পাঠক জানান, চাকরির নিত্য-নতুন বই কিনে পড়া অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমাদের মতো অনেকেই ছুটে আসেন এখানে। বিভিন্ন বইয়ের পাশাপাশি এখানে দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। পত্রিকা পড়ে আমরা দেশ-বিদেশে ঘটে যাওয়া খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধ ও উপসম্পাদকীয়গুলোও পড়তে পারি।
স্থানীয় মো. শাওন বলেন, ‘অক্সিজেন’ জ্ঞানসমৃদ্ধ পাঠাগারটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে যেকোনো বয়সের মানুষ বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমরা চাই, পাঠাগারটি নিজস্ব স্থান পাক। সরকারিভাবে আমাদের এক খ- খাসজমি বরাদ্দ দেওয়া হলে আমরা পাঠাগারটি বড় আকারে স্থাপন করব। তখন আরও বেশি প্রান্তিক জনগণ এর সুবিধা পাবে।
অক্সিজেন লাইব্রেরির কর্ণধার ও সভাপতি মোজাহেদুর ইসলাম ইমন বলেন, হরিপুর উপজেলায় কোনো সরকারি পাঠাগার নেই। সেই প্রয়োজনীয়তা অনুধাবণ করে আমরা অক্সিজেন নামের এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করি। অক্সিজেন ছাড়া কোনো প্রাণী যেমন বাঁচতে পারে না, তেমনি শিক্ষা বা জ্ঞান ছাড়া আমরা মানুষ বলে বিবেচিত হই না। সে কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকার বইপ্রেমী ও জ্ঞানপিপাসু মানুষের জ্ঞানের চাহিদা মেটাতে আমাদের এই প্রয়াস।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিকাশ চন্দ্র বর্মন বলেন, অক্সিজেন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তাদের উদ্যোগে একটি পাঠাগার পরিচালিত হয়। এটি তরুণ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়। শিক্ষার্থীরাও এখানে নিয়মিত বই পড়তে যাতায়াত করে। আমরা পাঠাগারটির উন্নয়নে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। পাঠাগারটিকে আরও বড় আকার দেওয়ার চিন্তা আছে আমাদের। এ জন্য চলতি বছরে তাদের আর্থিক অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া তারা খাসজমি চেয়ে আবেদন করলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন