শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আব্দুল মোমিন, সাতক্ষীরা 

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০২:০৯ এএম

সুন্দরবনে দস্যুতা বাড়ায় আতঙ্কে জেলেরা 

আব্দুল মোমিন, সাতক্ষীরা 

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০২:০৯ এএম

সুন্দরবনে দস্যুতা বাড়ায় আতঙ্কে জেলেরা 

** জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ধরতে যান জেলেরা
** অপহরণের কারণে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ
** বনে সক্রিয় খোকাবাবু বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী ও কাজল বাহিনী
** প্রতিটি নৌকা বনে প্রবেশের আগে ২০ হাজার টাকায় তথাকথিত ‘কার্ড’ সংগ্রহ করতে হয়

সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। এ বন শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, হাজারো জেলের জীবিকার ভরসাস্থল। কিন্তু আজ সেই সুন্দরবনই জলদস্যু ও বনদস্যুদের তৎপরতা বাড়ায় জেলেদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। জেলেদের কাছে এখন নদীর জোয়ার-ভাটা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা বাঘের ভয় নয়Ñ এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হলো জলদস্যু ও বনদস্যুরা। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কয়রার জেলেরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছেন মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরতে। তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদের পরিবার থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।

সুন্দরবনে তিনটি দস্যুবাহিনী সবচেয়ে সক্রিয় রয়েছে। এর  মধ্যে আবার ভারতীয় জলদস্যুদের উৎপাত বাড়ায় জেলে ও তাদের পরিবারের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। 

দীর্ঘ তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশের পাস-পারমিট বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর তা খুলে দেওয়ায় জেলে পরিবারে হাসি ফুটে। জেলেরা মহাজনি সুদের ঋণ পরিশোধের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ, কাঁকড়া ধরার জন্য সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু জলদস্যুদের আক্রমণ ও অপহরণের কারণে অনেক সময় গুনতে হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।

ষাটোর্ধ্ব আব্দুস সাত্তার, শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। বয়সের ভারে ন্যূব্জ হলেও সংসারের অভাব মেটাতে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। তিনি বলেন, ‘গত ২৪ আগস্ট মাছ ধরতে সুন্দরবনে যাই। পরদিন বনদস্যুরা আমাকে আটক করে। তারা প্রথমে ২৫ হাজার টাকা দাবি করে। অনেক দরকষাকষির পর ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ হয়। ধারদেনা করে পরিবার টাকা পাঠালে মুক্তি পাই।’

সাত্তারের অভিজ্ঞতা একক ঘটনা নয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই সময় অন্তত সাত জেলে মুক্তিপণের ফাঁদে পড়ে টাকা দিয়ে বেঁচে ফিরেছেন। কিন্তু এসব ঘটনার বেশির ভাগই সামনে আসে না। বর্তমানে সুন্দরবনে তিনটি দস্যুবাহিনী সবচেয়ে সক্রিয়Ñ খোকাবাবু বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী ও কাজল বাহিনী। এর মধ্যে খোকাবাবু ও দুলাভাই বাহিনীর নাম শোনা গেলেও সম্প্রতি কাজল বাহিনী ও ভারতীয় জলদস্যুর উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় জেলেদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। 

গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে শ্যামনগরে সুন্দরবনের জলদস্যু কাজল-মুন্না বাহিনীর তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যশোরের অভয়নগর থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় মুক্তিপণের ৭৪ হাজার টাকা, মোবাইল ও বিকাশ নম্বরের সিম জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলোÑ সাহা সুব্রত মল্লিক, বিপ্লব রায় ও লক্ষ্মণ বিশ্বাস। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিম্মি দুই জেলে আব্দুস সালাম ও বিজয় ধীবরকে সুন্দরবন থেকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিপণের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি নৌকা সুন্দরবনে প্রবেশের আগে ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি তথাকথিত ‘কার্ড’ সংগ্রহ করতে হয়। এ কার্ড আসলে দস্যুদের কাছ থেকে বেঁচে ফেরার ফি। কিন্তু একবার টাকা দিলেই মুক্তি মেলে না। কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর আবার নতুন অজুহাতে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।

দস্যুরা সরাসরি টাকা নেয় না। স্থানীয় এজেন্ট ও বিকাশের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়। জেলেদের অভিযোগ, গাবুরার চাঁদনীমুখার ‘মহিউদ্দিন’ নামে একজন খোকাবাবুর বাহিনীর হয়ে কার্ড সরবরাহ করেন। আবার চাঁদনীমুখার মনিরুল টেলিকমের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়। মনিরুলের স্ত্রী ও দোকানের পরিচালক সুফিয়া বেগম বলেন, কয়েকজন জেলে দোকান থেকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছে। তবে কার কাছে পাঠিয়েছে, সেটা জানা নেই।

স্থানীয় জেলেরা অভিযোগ করেন, চাঁদা না দিলে দস্যুরা নৌকা আটক করে জেলেদের গাছে বেঁধে মারধর করে। অনেক সময় দিনের পর দিন আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। কারো কারো পরিবার ঘরবাড়ি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে বাধ্য হয়। দস্যুতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ।

রাশিদুল ইসলাম (৩৫) ও আতাউর রহমান (৩২) শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি ও টেংরাখালী গ্রামের বাসিন্দা। রাশিদুল ও আতাউরের পিতার নাম যথাক্রমে মান্নান বরকন্দাজ ও সামছুর রহমান। ১৭ সেপ্টেম্বর তাদেরসহ আরও চারজনকে অপহরণ করা হয়। তখন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেলিন নৌকা মালিক মমতাজ ভাঙি মোশারফ হোসেন। সেখান থেকে ফিরে আসা জেলেদের সহযোগীরা দাবি করেছেন, জলদস্যুরা মুক্তিপণের জন্য আমাদের সহকর্মীদের জিম্মি করেছে। জলদস্যুদের একটি ৯ সদস্যের দল চারটি আগ্নেয়াস্ত্র ও একটি ভারতীয় নৌযান নিয়ে হামলা চালায়। সকালের দিকে দুজনকে মাছের নৌকা থেকে তুলে নেওয়ার পর দুপুরের সময় চারটি পৃথক নৌকা থেকে আরও চারজনকে জিম্মি করে।

টেংরাখালী গ্রামের নুরুল হক জানান, দুই দিন আগে বনবিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে তারা তিনজন বনে গিয়েছিলেন। গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে জলদস্যুরা একটি বড় ভারতীয় নৌকা নিয়ে আসে এবং অপহরণের চেষ্টা চালায়। এ সময় তারা তিনজন নৌকা ত্যাগ করে বনের ভেতরে চলে গেলে, জলদস্যুরা শুধু নৌকা নিয়ে চলে যায়।

২০১৮ সালে সরকার ঘোষিত আত্মসমর্পণ কর্মসূচিতে সুন্দরবনের ২৬টি দস্যুবাহিনীর প্রায় ৩৩২ সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই পুরোনো বাহিনীর সদস্যরা আবারও সক্রিয় হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি দুর্বল হওয়ার সুযোগে তারা নতুন করে দস্যুতায় ফিরেছে। দস্যুদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ আছে। বিকাশ লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করা গেলে চাঁদাবাজি অনেকটা কমবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা সম্ভব নয়।

শ্যামনগর থানার ওসি হুমায়ুন বকর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে বন বিভাগ জানায়, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। বুড়িগালিনী স্টেশনের কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। আমরা এক অভিযানে ১৩ জেলেকে উদ্ধার করেছি। তবে দস্যুরা পালিয়ে যায়।’ সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মুকিত খান বলেন, সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে।

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার (এসপি) মনিরুল ইসলাম ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত বিট পুলিশিং সভায় ঘোষণা দিয়েছেন, সুন্দরবনের জলদস্যুদের সঠিক তথ্য দিলে নাম-পরিচয় গোপন রেখে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!