শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


নুসরাত রুষা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০১:০২ এএম

শিবিরের জয়; ঢাবি ক্যাম্পাসের বর্তমান হালচাল

নুসরাত রুষা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০১:০২ এএম

শিবিরের জয়; ঢাবি ক্যাম্পাসের বর্তমান হালচাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি গণআন্দোলন, রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তন এবং সংস্কৃতির উন্মেষে এ ক্যাম্পাসের ভূমিকা অপরিসীম। দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভেবেছিল, এবার হয়তো নতুন করে গণতন্ত্রের বাতাবরণ ফিরে আসবে, ভিন্নমতের শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে কথা বলার এবং রাজনীতি করার স্বাধীনতা ফিরে পাবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা যেন নতুন এক শঙ্কার জন্ম দিল। কারণ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির এমন এক ভূমিধস জয় অর্জন করেছে, যা ক্যাম্পাসের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিক নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।

ফল ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। অনেকেই খোলাখুলি বলেছেন, পুরো প্যানেলকে একপক্ষীয়ভাবে জেতানো আসলে গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। ডাকসুর উদ্দেশ্য হলো বহুমতের প্রতিফলন ঘটানো, যাতে বিভিন্ন ধারা থেকে আসা নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কিন্তু শিবির যখন প্রায় পুরো প্যানেল দখল করল, তখন ক্যাম্পাস যেন এক রঙের রাজনীতির দিকে হাঁটা শুরু করল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করছে, অনেক যোগ্য প্রার্থী ছিলেন ঢাবিতে, যাদের উপেক্ষা করে এককভাবে শিবিরকে জেতানোটা আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক আবেগের ভুল হিসাব।

এখন পর্যন্ত নির্বাচিত শিবির নেতারা সরাসরি কোনো চাপ বা সহিংসতা সৃষ্টি করেনি, যা স্বস্তির বিষয়। তারা বরং নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে অপেক্ষাকৃত নীরব থেকেছে। কিন্তু সমস্যা তৈরি করছে তাদের সমর্থকেরা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আড্ডাস্থল, হল কিংবা শ্রেণিকক্ষে শিবির সমর্থকদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে এবং তারা প্রায়ই অন্য মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছে। আগে যেখানে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীরা সহাবস্থানে অভ্যস্ত ছিল, এখন সেখানে হুমকি-ধমকি বা ঝগড়াঝাঁটি বেড়ে যাচ্ছে।

এ পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে সামাজিক সম্পর্ককে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক জায়গা যেখানে ভিন্ন রাজনীতি, ভিন্ন দর্শন ও ভিন্ন মতাবলম্বী শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে, একসঙ্গে ক্যানটিনে বসেছে, এমনকি আন্দোলনে একে অপরের পাশে থেকেছে। কিন্তু শিবিরের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেই সহাবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্বাসের ভাঙন তৈরি হচ্ছে, আর তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। কার্জন হলে শিবিরের একজন কর্মী ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন, যেখানে তিনি কয়েকজন শিক্ষার্থীর পোশাক ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সেটিকে ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আখ্যা দেন। এটি নিছক একটি পোস্ট হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ‘মোরাল পুলিশিং’-এর প্রবণতা, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের নামান্তর। বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের জায়গা। অথচ এখন শিবির সমর্থকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছে আক্রমণাত্মক প্রচারণার জন্য। কেউ শিবিরের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। কটূক্তি, ব্যক্তিগত আক্রমণ, গালাগাল, এমনকি চরিত্রহননের মতো ঘটনাও ঘটছে।

এই পরিবেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে বলছেন, শিবির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে তারা যা খুশি লিখতে পারতেন, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ করতে পারতেন কিংবা ক্যাম্পাস রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করতেন। কিন্তু এখন সেই সাহস আর পাচ্ছেন না। তাদের আশপাশের বন্ধুরা সতর্ক করে দিয়েছে, শিবিরের অন্যায় দেখলেও যেন চুপ করে থাকা হয়। ফলে আত্ম সেন্সরশিপের একটি সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ভয়ে নিজেদের কলম থামিয়ে রাখছে।

অন্যদিকে বাইরের সমাজে শিবিরের জয়কে ঘিরে ভয় অনেক বেশি। ঢাকার বাইরের সাধারণ মানুষ ভাবছে, হয়তো ক্যাম্পাসে ভয়ঙ্কর সহিংসতা শুরু হবে, ভিন্নমতকে দমন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এখনো শিবির সেভাবে ক্যাম্পাসে দমনমূলক আচরণ শুরু করেনি। তবে এ অবস্থায় আশঙ্কা থেকেই যায়, একক আধিপত্য যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ধীরে ধীরে ভিন্নমতের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ ও দমননীতিই প্রাধান্য পায়।

শিবিরের এ ভূমিধস জয়ের পেছনে কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে সংগঠিতভাবে ক্যাম্পাসে কাজ করেছে। অন্যদিকে প্রগতিশীল ও বামঘেঁষা শক্তিরা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত ছিল, ফলে তাদের ভোট ভাগ হয়ে যায়। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক আবহে ধর্মীয় আবেগও শিবিরকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। পাশাপাশি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রচারণা ছিল অত্যন্ত সক্রিয় ও প্রভাবশালী। সব মিলিয়ে তারা একটি কৌশলগত সাফল্য অর্জন করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাজনীতির পরীক্ষাগার। এখানকার পরিবর্তন জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়। শিবিরের এই জয় তাই নিছক একটি ক্যাম্পাস রাজনীতির ঘটনা নয়, বরং জাতীয় পর্যায়েও এর প্রভাব পড়তে পারে। যদি শিবির গণতান্ত্রিক আচরণ বজায় রাখে এবং অন্য মতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এগোয়, তবে এটি ভিন্ন ধরনের ইতিবাচক নজির হতে পারে। কিন্তু যদি তারা নিজেদের আধিপত্যকে প্রভাবশালী করে তোলে এবং বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় এক অন্ধকার সময়ে প্রবেশ করবে।

ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল আশার প্রতীক, পরিবর্তনের প্রতীক। কিন্তু শিবিরের এ একক বিজয় সেই আশাকে শঙ্কায় রূপ দিয়েছে। একদিকে নির্বাচিত নেতারা আপাতত সহিংসতা করছে না, অন্যদিকে তাদের সমর্থকদের আচরণ, মোরাল পুলিশিং, সাইবার বুলিং এবং সামাজিক সম্পর্কের ভাঙন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত বাতাবরণকে সংকুচিত করছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ডাকসুর জয় গণতন্ত্রের নয়, বরং নিয়ন্ত্রণের প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে।

নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!