দেশের একমাত্র মানসিক চিকিৎসাসেবায় বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতাল। বর্তমানে হাসপাতালটি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, জনবল সংকট, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, খানাখন্দে ভরা রাস্তার কারণে হাসপাতালটির বেহাল দশা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কর্মচারী সংকটে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। সংকট কাটিয়ে হাসপাতালটিকে আধুনিকায়ন করার দাবি সবার।
জানা যায়, অবিভক্ত ভারতবর্ষের এই অঞ্চল থেকে মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচিতে যেতে হতো। পাকিস্তান ও ভারত আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পর ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই জমিদার বাড়িতে মানসিক হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখনকার পাবনা জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী পাবনার মানসিক হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করেন। এর দুই বছর পর ১৯৫৯ সালে পাবনা শহরের অদূরে হেমায়েতপুরে ১১১ দশমিক ২৫ একর জমির ওপর হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। জমির বেশির ভাগই ছিল শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের। পরে এই হাসপাতালের ৩০ একর জমি পাবনা মেডিকেল কলেজকে দেওয়া হয়। প্রথমে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ছিল ৬০। ১৯৬৬ সালে প্রথম দফায় শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ ও পরে ২০০ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। হাসপাতালের মোট ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪টি পুরুষ আর ৫টি নারী ওয়ার্ড রয়েছে।
সময়ের চাহিদায় হাসপাতালটির শয্যাসংখ্যা বেড়ে ৫০০ শয্যায় উন্নীত হলেও বাড়েনি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসকের পদ। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। স্বল্পসংখ্যক কর্মচারী দিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের বহিঃবিভাগে রোগী দেখার সময়সীমা ও হাসপাতাল চত্বরের যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের নানা অভিযোগ।
হাসপাতাটিতে বর্তমানে ৩১ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত আছে ২২ জন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের ২টি পদই শূন্য। সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কারের ৪টি পদের মধ্যে ২টিই শূন্য। ২য় শ্রেণির ৩১৬টি পদের মধ্যে কর্মরত ৩০৯ জন। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের। অফিস সহায়ক ৪০টি পদের মধ্যে কর্মরত মাত্র ৫ জন। ওয়ার্ড বয় ৭০টি পদের মধ্যে কর্মরত ২৬ জন। কুক মশালচি ২০টি পদের মধ্যে কর্মরত ৮ জন। ৩০টি সুইপার পদের বিপরীতে কর্মরত মাত্র ১৫ জন। সব মিলিয়ে হাসপাতালটির ৬৪৩টি পদের মধ্যে কর্মরত আছে ৪৬৭ পদে।
হাসপাতালের বহিঃবিভাগে রোগী দেখার সময়সীমা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। বেলা ১২টা পর্যন্ত রোগী দেখা হয় বহিঃবিভাগে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোগী সঠিক সময়ে এসে পৌঁছাতে না পেরে বেকায়দায় পড়তে হয়। আবাসিক হোটেলগুলো মানসিক রোগীদের রাখতে চাই না। বাধ্য হয়ে হাসপাতালের পাশে অবস্থিত শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রমে গিয়ে রাত কাটাতে হয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই হাসপাতালটিকে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছেন পাবনা শহরবাসী ও বাইরে থেকে আসা মানুষগুলো। হাসপাতাল চত্বরে পার্কের মতো ফুচকা, চটপটি ও ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়। হাসপাতালের রোগীরা তাদের কৌতূহল এবং বিনোদনের বস্তুতে পরিণত হয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সরকারি কর্মকর্তারাও পাবনায় এলে এই হাসপাতালে পরিবারসহ বেড়াতে আসেন। এই অমানবিক আচরণ বন্ধে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপে সেটি সম্ভব হয় না।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. এহিয়া কামাল বলেন, এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে রোগীদের সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে পারছি না। ৫ জনের কাজ করাতে হচ্ছে একজনকে দিয়ে। জনবল সংকট সমাধানে বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আশা করি সমস্যার সমাধান হবে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন। সে সময় তিনি বলেন, হাসপাতালটির শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগসহ হাসপাতালটির মান উন্নয়নের একটি বৃহত্তর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা আগামী একনেকে উপস্থাপন করা হবে। একনেক সভায় পাস হলে হাসপাতালটির শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ শুরু হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন