আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আসন ভাগাভাগির হিসাব দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। আসন নিয়ে সরল অঙ্ক মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুরোনো রাজনৈতিক দল বিএনপিকে। বিষয়টি নিয়ে মিত্র দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে অস্বস্তি। শরিকদের অভিযোগ, তাদের গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হলেও অনেক বিএনপি নেতা এমন নির্বাচনি এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন, যেখানে মিত্র দলের নেতারাও মাঠে আছেন। তারা বলছেন, বিএনপি তৃণমূল প্রার্থীদের লাগাম টানতে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না দলটি। বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তারা। জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) প্রস্তাবিত পরিবর্তনের পরে বিষয়টি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। কারণ এই পরিবর্তনে মিত্র দলগুলো বিএনপির নির্বাচনি প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে প্রার্থী হতে পারবে না। এই সমীকরণ মেলাতে না পারলে বিএনপি শরিকদের আসন ছাড়লেও দলটির কোনো পরিচিত মুখ সেই আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে জয়ের আশা ফিকে হয়ে যেতে পারে শরিক দলের নেতার।
যেহেতু আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হতে পারে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নিয়ে ভোটের মাঠ গোছানোর কাজ করছে দলগুলো। পাশাপাশি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে বেড়েছে তৎপরতা। বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র দলগুলোর জন্য ৩০-৫০ থেকে আসন ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। তবে প্রয়োজনে আরো বাড়তে পারে এই সংখ্যা। এ ক্ষেত্রে মিত্র দলগুলোর প্রার্থীদের এলাকায় জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দেখবে তারা। তবে ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে বিএনপির কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তা মিত্রদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাস্তবতার নিরিখে ছোট ছোট দলের সাংগঠনিক শক্তি তুলনামূলক দুর্বল। তাদের ভরসা অনেকটাই বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের ওপর। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিধান অনুযায়ী, জোটের প্রার্থী হলেও নিজ দলের প্রতীকেই লড়তে হবে। এতে যেমন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের ভোটব্যাংক কাজে লাগানো যাচ্ছে না, তেমনি বিএনপি থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা স্বীকার করেছেন, মনোনয়ন না পেয়ে অনেক নেতা ক্ষুব্ধ হবেন। তাদের শান্ত করা সহজ হবে না।
আবার তাদের জায়গায় জয়ের সম্ভাবনা কমÑ এমন মিত্রদের আসন দেওয়ার ব্যাপারটি কঠিন হবে। তারা বলেন, ‘বিএনপি নেতারা মনোনয়ন চাইছেন। কিছু আসনে মিত্র দলের প্রার্থী থাকার পরও তারা প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাই সময় থাকতে বিএনপির উচিত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করা।’ তবে জানা গেছে, সেই সুযোগে ফাঁদ পেতেছেন বিএনপির নির্বাচনি মাঠের প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি থেকে মনোনয়ন না দিলে জামায়াত তাদের মনোনয়ন দেবে। জামায়াতের টার্গেটÑ বিএনপি নেতার যেসব অনুসারী আছেন, তাদের সাথে জামায়াতের ভোট যোগ করলে যোগফল ভালো হওয়া কিংবা জয়ের বন্দরে পৌঁছুতে বেশ সুবিধাই হবে।
বিএনপি গত দুই দিনে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রায় ২৫ জন জোটনেতার; তারা একই মত প্রকাশ করেছেন। এই দলগুলো পতিত আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় বিএনপির সঙ্গে ছিল। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের তথ্য মতে, প্রায় ৫৩টি দল তাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। সেই সূত্রে বিএনপির কাছে শতাধিক আসন চায় সমমনা দলগুলো।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি, চলছে তাদের প্রার্থী বাছাই। সব ঠিক থাকলে চলতি মাসেই আসনভিত্তিক একক প্রার্থী ঘোষণা দিতে চায় দলটি। একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চায় বিএনপি। এ জন্য তাদের সঙ্গে জোট অথবা আসন ছাড়েরও পরিকল্পনা আছে দলটির। বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর সূত্র বলছে, বিএনপির কাছে মিত্র দলগুলো শতাধিক আসন দাবি করেছে। তবে মিত্রদলগুলোর কাছ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা চেয়েছে বিএনপি। বেশ কয়েকটি দল ও জোট এরই মধ্যে তালিকা দিয়েছে। মিত্র কয়েকটি দলের একাধিক নেতা তালিকা নিয়ে আবার লন্ডনেও গেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলতে। কেউ আবার আগেই সবুজসংকেত পেয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছেন।
এর আগে, বিএনপি নির্বাচিত হলে জোট শরিকদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জোটে থাকা সেইসব নেতার জন্য আসন ছাড়া হবে, যাদের জয়ের সম্ভাবনা আছে। এরই মধ্যে গত আগস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় ৬০ জন নেতাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, জোটের নেতারা ভবিষ্যতে তাদের সরকারের অংশ হবে। দলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, তিনি নির্বাচনি প্রচারণা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং জরিপের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার ব্যাপারে ধারণা নিচ্ছেন।
জোটের আসন জটিলতায় বিএনপি প্রার্থীরা সতর্ক করেছেন, জোটের দুর্বল প্রার্থীদের আসন ছেড়ে দিলে দলের জন্য বড় ক্ষতি হতে পারে। এই যেমন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ও বিএনপি জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মজিদ প্রচারণা চালাচ্ছেন ঝিনাইদহ-২ আসনে। আব্দুল মজিদ বলেন, ‘দল যদি রাশেদকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে বিএনপি এই আসন হারাবে। রাশেদ এখানে সক্রিয় না, এখানে তার তেমন সমর্থক নেই।’ যদিও আব্দুল মজিদের এই দাবির সঙ্গে একমত নন রাশেদ খান। রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, একজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এ ধরনের মন্তব্য করা ‘উচিত না’। ‘আমি নিয়মিত এলাকায় যাই, মানুষের সঙ্গে দেখা করি। আমার এলাকার মানুষ আমাকে পছন্দ করে।’
একই ধরনের পরিস্থিতি কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এহসানুল হুদা ও বিএনপির মুজিবুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান বিএনপির টিকিটে। মুজিবুর জানান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একটি চিঠি দিয়ে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের কথা বলেছে। তবে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বলেনি। আর এহসানুল হুদা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমি নিয়মিত এলাকায় যাচ্ছি; বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী না দাঁড়ালে আমার জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। সেখানে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেকও মনোনয়নপ্রত্যাশী। আব্দুল খালেক মনে করেন, এই আসনে বিএনপির প্রতীক ছাড়া সাকির জেতার সম্ভাবনা ‘শূন্য’।
যদিও জোনায়েদ সাকি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে। বিএনপি যেসব আসন ছেড়ে দেবে, সেখানে তাদের নেতাকর্মীদের কীভাবে ম্যানেজ করবে, সেটা তারা ঠিক করবে।’ আমরাতো বিএনপি নেতাদের সাথে মারামারি করতে যাব না। যেহেতু ফ্যাসিবাদ পতনের আন্দোলন একসাথে করেছি, আগামী নির্বাচনও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করতে চাই।
এদিকে পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর ও বিএনপির হাসান মামুন প্রচারণা চালাচ্ছেন। হাসান মামুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নূরকে ছেড়ে দিলে এই আসন বিএনপি হারাবে এটা নিশ্চিত। স্থানীয়রা এখানে বিএনপির নেতা চান, কোনো মিত্র দলের কাউকে না।’ যদিও ইতিধ্যে ভোটের উত্তেজনা ও আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে এই জেলায়। জুনে গলাচিপা উপজেলায় বিএনপি ও গণঅধিকার কর্মীদের সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন।
বিএনপির একটি অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে প্রচারণাকে কেন্দ্র করে। এদিকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-৪ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে বিএনপির একজন প্রার্থীও মনোনয়ন চেয়েছেন। একই আসনের বিএনপি নেতারা জানান, জোটের কোনো দুর্বল প্রার্থীকে এই আসন ছেড়ে দিলে জয় পেতে সুবিধা হবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের।
তবে প্রার্থী চূড়ান্তে বিলম্ব করায় হতাশা বাড়ছে শরিকদের মধ্যে। জোটনেতারা বলছেন, আসন নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে বিএনপি দেরি করছে। এতে সবার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১২ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতা স্বীকার করেন, তৃণমূলে তাদের সংগঠন বিএনপির চেয়ে অনেক দুর্বল। ‘বিএনপি যদি এখনই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে পরে কীভাবে করবে?’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদটুকু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যেখানে জোট নেতাদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। তাদের সেই আসন ছেড়ে দেবে বিএনপি। যাদের দল মনোনয়ন দেবে তাদের নিশ্চয়ই সহযোগিতা করবে বিএনপি। তাদের তো জলে ফেলে দেব না। তাদের জিতিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তবে জোট শরিকদের সব চাওয়া হয়তো পূরণ করতে পারব না; তাতে করে কেউ যদি গোস্বা করে অন্য কারো সাথে চলে যায় তাহলে তো কিছু করার থাকবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক আলোচনা তো সব দলের সঙ্গেই হয়। এনসিপির সঙ্গেও হয়। তবে আসনভিত্তিক কোনো আলোচনা তাদের সঙ্গে হয়নি। তবে বিএনপির সাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা ছিল, তাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। মাঠের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে, যাদের গ্রহণযোগ্যতা ও জয়ের সম্ভাবনা আছে, তাদের আসন ছাড়া হবে। তবে কত আসন ছাড়া হবে সেটা বলে দেবে সময়। সবাইকে হয়তো খুশি করতে পারব না। তবে নিরাশ যাতে না হয় সেটি মাথায় রেখেই কাজ করছি আমরা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন