১৩ বছর বয়সি স্কুলছাত্রী নাঈমা ইসলাম (ছদ্মনাম)। এক ভাই আর বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় বসবাস করেন। স্কুলের মাঠে ডানা মেলে উড়ে উড়েই যখন কাটছিল জীবন, তখন হঠাৎ একদিন ছন্দপতন। বুকের ডান পাশের স্তনে ছোট্ট একটি ফোঁড়া ওঠে। কোনো পোকামাকড় কামড় দিয়েছে ভেবে এড়িয়ে গেলেও বিপত্তি ঘটে যখন এক রাতে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।
বাবা-মায়ের কাছে এত দিন লুকিয়ে রাখলেও মাঝরাতে তীব্র ব্যথায় কাতর নাঈমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তারা। পরদিন সকালেই নিয়ে যান রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ডাক্তার সব দেখে-শুনে দিলেন ক্যান্সারের জীবাণু পরীক্ষাসহ নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চিন্তা আরও বেড়ে যায় পরিবারের। শেষ পর্যন্ত ক্যান্সার না হলেও আর কয়দিন অবহেলা করলেই মারাত্মক কিছু ঘটতে পারত বলে জানান চিকিৎসকরা। ক্যান্সার না হলেও টিউমার ধরা পড়ে নাঈমার। দ্রুততার সঙ্গে অস্ত্রোপচার করে টিউটমারটি ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। অল্পের জন্য বেঁচে যায় কচি প্রাণ।
নাঈমা বাঁচলেও বাঁচতে পারেননি মুন্নী আক্তার। ২৬ বছরের টগবগে তরুণী দুই সন্তানের মা ছিলেন। হঠাৎ করেই গত বছরের শেষের দিকে স্তনে ফোঁড়া দেখতে পান। নাট্যকর্মী মেয়েটির পরিবার সচেতন হলেও এই ফোঁড়ার ব্যাপারে যেন ছিল অনীহা। দেখতে দেখতে যা প্রথমে টিউমার, পরে ক্যান্সারে রূপ নেয়। দেশেই কেমোথেরাপি দিয়ে পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের চেন্নাইয়ে গিয়ে অস্ত্রোপাচার করলেও হয়নি শেষরক্ষা। চলতি বছরের মে মাসে মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। ৪ জনের হাসিখুশি পরিবার দেখে যে কেউই যেখানে ফেলত স্বস্তির নিঃশ্বাস। সেই পরিবারে আজ বিরাজ করছে নিকষ কালো অন্ধকার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার স্বামী নিয়ন বলেন, গত বছরের শুরুতেই ডান দিকের স্তনে একটি ফোঁড়া দেখতে পাই। ফোঁড়া তো শরীরের যেকোনো জায়গায়ই হয়। এ আবার এমন কী? এদিকে অফিসে কাজের চাপও খুব বেশি। কয়দিন পরই ডাক্তারের কাছে যাব ভাবী। সেই কয়দিন পর এক মাসে গিয়ে গড়ায়। মে মাসের এক সকালে দেখি ফোঁড়াটি শক্ত হয়ে আছে। আর কোনো দিকে চিন্তা না করে ছুটে যাই পার্শ্ববর্তী একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
চিকিৎসক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি দেন বায়োপসি পরীক্ষাও। ফলাফল ক্যান্সারের দ্বিতীয় স্তর। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। চিকিৎসককে সব রিপোর্ট দেখালে জানান, আর কয়টা দিন আগে আসলেও হয়তো ক্যান্সার হতো না। এত দেরি করলেন যে প্রথম স্তর শেষ হয়ে দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে। এখন আর অস্ত্রোপচার করে স্তন কেটে ফেলা ছাড়া কোনো সমাধান নেই। তবে এর আগে কোমোথেরাপি দিয়ে শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু মেরে ফেলতে হবে। অন্তত ৮টা কেমোথেরাপির পরই অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হবে। এরপর দিতে হবে রেডিওথেরাপিও।
সব মিলিয়ে অন্তত ১ বছর সময় লাগবে পুরো চিকিৎসা শেষ হতে। সব ঠিক থাকলে সুস্থ হয়ে উঠবেন আর না হয় কিছু বলা যাচ্ছে না। দেশের চিকিৎসার ওপর ভরসা কম থাকায় নিয়ে যাই ভারতে। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। সামান্য অবহেলা হারিয়ে ফেললাম জীবনসঙ্গীকে। মানুষটাকে তো হারিয়েছি সঙ্গে শেষ হয়েছে জমানো সব টাকা-পয়সাও। এমনকি বাড়ির জমি বিক্রি করে পর্যন্ত চালাতে হয়েছে চিকিৎসা।
মুন্নীর মতো শুধু সচেতনতার অভাবেই দেশের অধিকাংশ নারীই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে নিয়মিত স্ক্রিনিং করেন না। যেখানে শুধু স্ক্রিনিংয়েই বাঁচতে পারে অনেক প্রাণ। চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর অন্তত ১৩ হাজার নারী নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন স্তন ক্যান্সারে। এদের মধ্যে করুণমৃত্যু বরণ করছেন ৬ হাজারের বেশি নারী। তাই স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে অক্টোবর মাসের পুরোটাকে ঘোষণা করা হয়েছে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস। আর আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস।
‘জেনে নিন, জেগে উঠুন, স্ক্রিনিং জীবন বাঁচায়’ প্রতিপাদ্যে পালিত হতে যাওয়া দিবসটির গুরুত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষণ না থাকলেও ঝ্ুঁকিপূর্ণ নারীদের সহজ ও ব্যথা-কষ্টবিহীন পদ্ধতি প্রয়োগ করে গোপন থাকা ক্যান্সার নির্ণয় করাকে ক্যান্সার স্ক্রিনিং বলা হয়। স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলেও সময়মতো পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারলে শতকরা ৯০ ভাগ রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব। নিয়মিত স্ক্রিনিং করলে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব। আর তাই স্ক্রিনিংকে গুরুত্ব দিতেই গত বছরের মতো চলতি বছরও স্তন ক্যান্সারের প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘স্তন ক্যান্সার, চাই দ্রুত নির্ণয় ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা’।
এত দিন শুধু স্ক্রিনিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হলেও চলতি বছর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায়ও জোর দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অনেকে অস্ত্রোপচার করলেও রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দেন না সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে। তাই চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা সহজলভ্য করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএআরসি (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার) এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন এই ক্যান্সারে। সংখ্যায় কম হলেও পুরুষদেরও এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা। আর তাই এই মারাত্মক ব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর (আজ) দেশে পালিত হয় দিবসটি।
বাংলাদেশে ১ অক্টোবর থেকে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস পালন করা হয় জানিয়ে স্তন ক্যান্সার নিয়ে কাজ করে এমন ৩০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরাম উদ্যোক্তা ও প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর এই ফোরাম গঠিত হয় এবং তখন থেকেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১০ অক্টোবর বাংলাদেশে ফোরামের আহবানে বেসরকারিভাবে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তিনি বলেন, এতদিন আমরা স্ক্রিনিংকে গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু এখন সময় এসেছে স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি রোগী যেনো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। স্ক্রিনিং কার্যক্রম সব মানুষের দোরগোড়ায় তো নিয়ে যেতে হবেই পাশাপাশি বিভাগ এবং জেলা পর্যায়ে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি কার্যক্রমগুলো সহজলভ্য করতে হবে।
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, আইএআরসি বলছে আফ্রিকান সাব সাহরান ৫ দেশে এক গবেষণায় তারা পেয়েছে, স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের ৭ বছর পর্যন্ত বাঁচে প্রতি তিন রোগীর মাত্র একজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মনে করি, আমাদের দেশে কোনো গবেষণা না করলেও আমার ধারণা বাংলাদেশে এর থেকে খুব বেশি উন্নত হবে না। তার মানে এটি একটি বিপজ্জনক বিষয় যে ৭ বছর পর্যন্ত বাঁচে মাত্র ৩ জনের ১ জন। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে আরেকটা তথ্য যেটা বলছে সেটা হলো ১৩ হাজার আক্রান্ত হচ্ছেন আর ৬ হাজার মারা যাচ্ছে। তার মানে প্রায় ৪০ শতাংশ আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে দেশে এই ক্যান্সারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৪০ বছরের বেশি বয়স্ক নারীদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ মা-খালাদের থাকলে সন্তানদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। অবিবাহিতা বা সন্তানহীনা নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেসব মায়েরা সন্তানকে কখনো বুকের দুধ খাওয়াননি তাদেরও স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু তাই নয়, ৩০ বছরের পরে যারা প্রথমবারের মতো মা হয়েছেন, তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া যাদের তুলনামূলক কম বয়সে মাসিক শুরু হয় ও দেরিতে মাসিক বন্ধ হয় তারাও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন। একাধারে অনেকদিন (১০ বছর বা বেশি) জন্ম নিরোধক বড়ি খেলেও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হিসেবে চিকিৎসকরা জানান, স্তনের বোঁটা থেকে কিছু বের হওয়া, স্তনের ভেতর চাকা অনুভব করা, স্তনে ব্যথা অনুভব করা, আকারে লক্ষণীয় পরিবর্তন, স্তনের ত্বকে ঘা দেখা দেওয়া, স্তনের ত্বকে লালচে ভাব বা লালচে দাগ দেখা দেওয়া এর মধ্যে অন্যতম।
দিবসটি উপলক্ষে আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভা ও প্রতীকী গোলাপি শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরাম। ২০১৩ সাল থেকে এই ফোরামের উদ্যোগে দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এই ফোরামে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রায় পঞ্চাশটি অলাভজনক সংগঠন অন্তর্ভুক্ত আছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন