বাংলাদেশের সাহিত্য, একাডেমিয়া ও চিন্তার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নিভে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আর নেই। শুক্রবার বিকেল ৫টায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার প্রস্থান শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, এ যেন বাংলাদেশের সাহিত্য ও মানবিক চেতনার এক যুগের অবসান।
১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেট শহরে জন্ম নেওয়া সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শৈশব ছিল পাঠাভ্যাসে ও কৌতূহলে পরিপূর্ণ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের কাব্যজগত নিয়ে গবেষণা করেন এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগ দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষকতার এক কিংবদন্তি নাম। ক্লাসরুমে তার আলোচনার ভঙ্গি ছিল সংলাপধর্মী, চিন্তা-উদ্দীপক এবং মানবিক। আর এ কারণেই হয়তো তার ছাত্ররা বলতেন ‘স্যার যেমন আমাদের পড়াতেন, তেমনি ভাবতেও শেখাতেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) যোগ দেন, যেখানে তিনি পড়াতেন সাহিত্য, সৃজনশীলতা ও জীবনদর্শনের মিশ্রিত পাঠ।
বাংলা কথাসাহিত্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আবির্ভাব এক নতুন সময়ের সূচনা। তার গল্পে বাস্তবতা কখনো কেবল দৈনন্দিন নয়, বরং তা হয়ে ওঠে প্রতীকময়, স্বপ্নীল ও জাদুবাস্তব।
‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘অন্তঃসত্ত্বা সময়’, ‘গল্প ও গেরিলা’, ‘মোহাম্মদ’, ‘অন্ধকারের মানুষজন’, ‘গোলাপী হাওয়া’ সব বইয়েই দেখা যায়, তিনি ছোট ছোট ঘটনাকে রূপান্তরিত করেছেন জীবনের বৃহত্তর রূপকে।
জাদুবাস্তবতার এ ধারায় তিনি একদিকে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের প্রভাবকে আত্মস্থ করেছেন, অন্যদিকে সৃষ্টি করেছেন এক স্বকীয় বাংলা পরিসর যেখানে রাজনীতি, প্রেম, বিশ্বাস, মৃত্যুভয় ও মানবিক আশা-আকাক্সক্ষা মিশে যায় এক অনন্য বয়নকৌশলে।
তার গল্পে যে ‘অতিবাস্তবতা’, তা আসলে বাস্তবতারই এক গভীর রূপ-যেখানে মানুষকে দেখা যায় তার ভেতরের আলো ও অন্ধকার নিয়ে।
২০০৫ সালে প্রেম ও প্রার্থনার গল্প প্রথম আলো বর্ষসেরা সৃজনশীল বইয়ের পুরস্কার পায়। ১৯৯৬ সালে তিনি অর্জন করেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৮ সালে একুশে পদক।
গল্পের পাশাপাশি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এক বিশ্লেষণধর্মী প্রাবন্ধিক। তার প্রবন্ধে পাওয়া যায় সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ, ইতিহাস ও দর্শনের গভীর যোগসূত্র।
তিনি লিখেছেন নন্দনতত্ত্ব, সৃষ্টিশীলতা ও মানবিক চেতনার বিষয়ে। তার মতে, ‘সাহিত্য মানে কেবল সৌন্দর্যের আরাধনা নয়, বরং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার এক রূপ।’
তার অনেক লেখা ও বক্তৃতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের সীমাবদ্ধতা, একাডেমিক অনুশাসনের জড়তা এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান।
তার লেখায় একদিকে ছিল তীক্ষè বিশ্লেষণ, অন্যদিকে ছিল কবিত্বময় মমতা। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি ছাত্রদের চোখে সাহিত্যের ভেতরে মানুষকে দেখতে শিখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘যদি আমরা গল্প পড়ি, তাহলে আমাদের মানবিকতা বাড়ে।’
তার ক্লাসে ইয়েটস, শেক্সপিয়ার বা টনি মরিসন কেবল পাঠ্যপুস্তকের নাম নয়, তারা হয়ে উঠতেন জীবন্ত চরিত্র, যাদের মাধ্যমে তিনি সমাজ, নৈতিকতা ও নন্দন নিয়ে আলোচনা করতেন।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার কাছ থেকে পেয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা, যুক্তির সৌন্দর্য এবং ভাষার প্রতি মমতা। অনেক প্রাক্তন ছাত্র এখনো বলেন, ‘স্যার আমাদের শুধু ইংরেজি শেখাননি, মানুষ হতে শিখিয়েছেন।’
২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক এক দিন আগে দেশের একটি প্রত্রিকায় তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ হলো। মনোযোগ দিয়ে লেখাটা পড়লাম। পত্রিকাটি তখন ‘রাষ্ট্র মেরামতের সেই সুযোগ আবার এসেছে’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছিল। সেই সময় চলমান আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেছিলেন, যা ঘটেছে, তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি শুরুতে ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ও শান্তিপূর্ণ। তাদের দাবিগুলো ছিল যৌক্তিক এবং আমার ধারণা ছিল, যেহেতু তারা কোটাপদ্ধতির সংস্কার চেয়েছে, বিলুপ্তি নয়; দাবিগুলো নিশ্চয় মেটানো হবে। কিন্তু শুরু থেকেই যেভাবে এই শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা হয়েছে এবং শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে তাদের বিক্ষোভের মাত্রাটিই শুধু বেড়েছে।
সরকারি দলের নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও আবেগকে বুঝতে পারেনি এবং আন্দোলনটি যে এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে, তা-ও ধারণা করতে পারেনি। আদালতের রায় শেষ পর্যন্ত দ্রুতই পাওয়া গেল, অথচ শুরুতে এর জন্য সময়ক্ষেপণ করা হলো। ফলে আন্দোলনটি তীব্র হলো এবং একপর্যায়ে তা শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। এরপর যা ঘটল, তা স্তম্ভিত করার মতো। এগুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।
পতিত সরকারে গণহত্যা নিয়ে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই, এর আগে কোনো গণবিক্ষোভে এত প্রাণ ঝরে পড়েনি, এত রক্তপাত হয়নি। এর একটি কারণ সাড়ে তিন দশক ধরে চলে আসা রাজনীতির ক্রমাগত গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। আমাদের নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ, তাতে বহুদলীয় অংশগ্রহণ নেই, ফলে একটি সক্রিয় সংসদ নেই। এ রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অনুপস্থিত। এর দায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের, তবে প্রধানত যারা সরকার পরিচালনা করেন, তাদের। আমাদের রাজনীতিতে তারুণ্যের অংশগ্রহণ নেই, এ রাজনীতি প্রবীণসর্বস্ব। তারুণ্যকে বুঝতে এ রাজনীতি অক্ষম।
তা ছাড়া লাগামহীন দুর্নীতি, বিচারহীনতা, লুটপাটের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, বাজারজুড়ে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ, অতিকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থচিন্তা রাজনীতিকে বিপথগামী করে। এ রাজনীতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।
তিনি ছিলেন নিভৃতচারী অথচ সবার আপন। লেখালেখির বাইরে তিনি ছিলেন সংস্কৃতি ও সমাজচিন্তার এক নীরব শক্তি। সাদামাটা জীবন, স্পষ্টভাষী মনোভাব ও মানবিক হাস্যরস তাকে করে তুলেছিল ভীষণ প্রিয়।
বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের ভাষায়, তিনি ছিলেন ‘একজন বিনয়ী দার্শনিক’, যিনি নীরবে কাজ করে যেতেন, প্রচারের আলোয় আসতেন না কখনো।
তার সারল্য বরাবরই মুগ্ধ করত অনুজদের। সম্প্রতি একটা ঘটনা বলি, আমার একসময়ের কলিগ কথাসাহিত্যিক ও কণ্ঠশিল্পী লুৎফর হাসানের সঙ্গে দেখা হতেই খুব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমাকে বললেন ভাই এক জীবনে আর কিছু পেত চাই না। আমি তাকে বললাম কী হয়েছে ভাই। তিনি জানালেন, মোহন’ নামের একটি গল্পে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লুৎফর হাসানের কথা বলেছেন আনন্দের সঙ্গেই। সেই অনুভূতি লুৎফর হাসান ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন এভাবে, বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক, শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার উনার একটা গল্পে আমার কথা লিখেছেন। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রিয় বড় ভাই আব্দুল্লাহ নাসের এইমাত্র সেই গল্পের অংশবিশেষ পাঠালেন। আমার হাত-পা কাঁপছে। কী বিরাট এক প্রাপ্তি আমার।’ এই যে এত মহানুভবতার উদাহরণ। তার সমসামীয়ক ক’জন লেখকই দিতে পেরেছেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এক সেতুবন্ধন, যিনি যুক্ত করেছেন বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য, বাস্তব ও কল্পনা, শিক্ষা ও সৃজনশীলতা, জীবন ও ভাবনা। তার প্রস্থান এক যুগের অবসান হলেও, তার লেখা আমাদের মনে করিয়ে দেবে ‘সাহিত্য কেবল কাগজে নয়, মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকে।’
গত ৩ অক্টোবর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে তিনি ছিলেন হাসপাতালে। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও ফিরে আসা হলো না এই মানবিক সাহিত্যিকের। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে থাকার পর শুক্রবার বিকেল ৫টায় তিনি পাড়ি জমান অমোঘ অনন্তে।
তার মৃত্যুতে সাহিত্যজগৎ শোকাহত। লেখক-শিক্ষক-ছাত্র সবাই অনুভব করছেন এক ব্যক্তিগত ক্ষতি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া গল্প, প্রবন্ধ ও চিন্তার উত্তরাধিকার আমাদের পথ দেখাবে আরও বহু বছর।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একবার লিখেছিলেন, ‘জীবনের মানে আমরা খুঁজে পাই না, কারণ আমরা গল্প বলতে ভুলে গেছি।’ আজ, তার চলে যাওয়ার পর, মনে হলো তিনি নিজেই যেন এক গল্প হয়ে গেলেন। এমন এক গল্প, যা বাস্তব ও স্বপ্নের সীমানা মুছে দিয়ে আমাদের শেখায় মানুষের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অশেষ সম্ভাবনার আলো।
ওমর ফারুক, সাংবাদিক
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন