- ৯ শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৬৫.৮২ ও হিসাববিজ্ঞানে ৭১.৫৮ শতাংশ
- মানবিকে পাসের হার ৪৮.২৩ ও বাণিজ্য বিভাগে ৫৫.৫৮ শতাংশ
- মূল্যায়নে কড়াকড়ি আর প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ায় ফল বিপর্যয়ের কারণ বলছেন অনেকে
- আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির ভাষ্য এই ফল শিক্ষার বাস্তব চিত্র। শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে তার ওপর মার্ক দেওয়া হয়েছে
এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এর প্রভাব পড়েছে পরীক্ষার গড় ফলে। দুই বিষয়ের মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮২ শতাংশ আর হিসাববিজ্ঞানে পাসের হার ৭১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর বাইরে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও খুল ভালো ফল অর্জন করতে পারেননি। মানবিকে এবার পাসের হার ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ আর বাণিজ্য বিভাগে পাসের হার ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই মূল্যায়নে কড়াকড়ি আর প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ার কারণে ফল বিপর্যয়ের কথা বললেও তা মানতে নারাজ শিক্ষা বোর্ড। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি বলছে, এই ফল শিক্ষার বাস্তব চিত্র। শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে তার ওপর সঠিক মার্ক দেওয়া হয়েছে। কাউকে বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে মার্ক দেওয়া হয়নি।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৪ সালের পর থেকে এসএসসি ও এইচএসসিসহ পাবলিক পরীক্ষাগুলোয় পাসের হার বাড়তে থাকে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তা প্রতি বছরই রেকর্ড ছাড়ায়। তখন পরীক্ষা খাতা মূল্যায়নে ছিল উদার চর্চা মনোভাব। শিক্ষার্থীরা খাতায় লিখলেই দেওয়া হতো মার্ক। সেই কারণে ওই সময় জিপিএ-৫ ও পাসের হার বেশি থাকলেও পড়াশোনার মান নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে সেই ধারা থেকে বের হয়ে এসেছে। গত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় খাতা দেখায় ছিল কড়াকড়ি। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে সেই আলোকে মার্ক দেওয়া হয়েছে। কাউকে বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে মার্ক দেওয়া হয়নি। এবার এইচএসসি পরীক্ষায়ও যে যা লিখেছে সেই মার্ক দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘এই ফল বিপর্যয়কে খারাপ বলব না, এটা বাস্তব চিত্র। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ঠিকভাবেই হয়েছে। তবে এই ফল নিয়ে শিক্ষা বোর্ড, সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বসতে হবে। কেন কাক্সিক্ষত ফল শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারছে না তা খুঁজে বের করতে হবে।’
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর সব পাবলিক পরীক্ষা কঠোরভাবে নিতে, পরীক্ষা সুষ্ঠু ও নকলমুক্ত পরিবেশে করতে এবং খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করেছি অতি মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন যেন না হয়। যতটুকু লিখেছে ততটুকু নম্বর দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। যে কারণে পাসের হার একটু কম হয়েছে। তবে অন্যান্য বোর্ডের পাসের হার অনুযায়ী বরিশাল বোর্ডে ফল নিয়ে সন্তুষ্ট।’
এবারের এইচএসসির ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে বাংলায় গড় পাসের হার ৯০ দশমিক ৬২ শতাংশ, আইসিটিতে ৮২ দশমিক ১৯ শতাংশ, পদার্থবিজ্ঞানে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশ, যুক্তিবিদ্যায় পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এই চার বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করলেও ইংরেজি ও হিসাববিজ্ঞানে এসে ধরা খেয়েছেন। ইংরেজিতে পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮২ শতাংশ আর হিসাববিজ্ঞানে পাসের হার ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এর কারণ হিসেবে অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা বরাবরই খারাপ করে। আমরা মাতৃভাষাই দুর্বল আর ইংরেজি তো ভিন্ন ভাষা। তাই এ রকম হয়। হিসাববিজ্ঞানও কঠিন বিষয়। এসব বিষয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো শিক্ষক নেই। এ ছাড়াও আরও অনেক সংকট রয়েছে। এসব সংকট দূর করতে হবে।’
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শামছুল ইসলামও বলছেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘চলতি বছর পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি ও উচ্চতর গণিতে পাসের হার কম। এর পেছনে শিক্ষকদের দক্ষতারও কিছু ঘাটতি থাকতে পারে। আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। ফল খারাপ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনের কারণ জানার চেষ্টা করা হবে।’
সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জানান, ‘ইংরেজিসহ কয়েকটি বিষয়ে খারাপ ফলের কারণে সামগ্রিক ফল খারাপ হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া, দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি ও বিজ্ঞানবিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক না থাকায়ও সার্বিক ফলে প্রভাব পড়েছে।’
এবার বিজ্ঞানবিভাগের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল অর্জন করলেও মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ব্যাপক ফল বিপর্যয় হয়েছে। মানবিক বিভাগে গড় পাসের হার ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ আর বাণিজ্য বিভাগে পাসের হার ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অবশ্য মানবিক বিভাগে ফল খারাপ হওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদরা বলছেন, মানবিক বিভাগে সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা পড়াশোনা করে। তাই মূল্যায়নে কড়াকড়ি হাওয়া মানবিকে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আর বাণিজ্য বিভাগে কিছু কঠিন বিষয়। এর মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে প্রশ্ন এবার কঠিন আর ঠিকমতো মূল্যায়ন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ফেল করেছে বেশি।
মূল্যায়নে কড়াকড়ি নিয়ে নানা প্রশ্ন
এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার মূল্যায়নে ছাড় না দেওয়ার কারণে এই ফল বিপর্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও শিক্ষা বোর্ডগুলো বলছে, এই ফল শিক্ষার বাস্তব চিত্র। তবে শিক্ষাবিদদের অনেকেই বলছেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সংকট রয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশসহ নেই পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুদিন ক্লাসও হয়নি। এই সংকটগুলো সমাধান না করে হুট করে মূল্যায়নে কড়াকড়ি আনা খুব একটা উচিত হয়নি।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, ‘সরকার এ বছর চেয়েছে, যেন মেধার মূল্যায়ন হয়। তাই প্রশ্ন ও খাতা দেখার ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। যার ফলে সামগ্রিক ফল খারাপ হলেও প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হয়েছে। প্রশ্নের ধরন বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে। তবে, আগে থেকে জানালে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিতে আরও সহজ হতো।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই ফলকে বাস্তবতার প্রতিফলন বলা যায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে দেখি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দক্ষতা থাকার তা নেই। এর কারণ হলো শিক্ষায় নানা সংকট রয়েছে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যে ধরনের একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন থাকার কথা তা নেই। মেধাবিরা শিক্ষকতায় আসছে না। শিক্ষা নিয়ে সরকারের পলিসি পরিবর্তন করতে হবে।’
একই বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম বলেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বলছেন, এবারের ফল শিক্ষার বাস্তব চিত্র। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, আগে অবাস্তব চিত্র ছিল? সেটা যদি তারা বলে তাহলে ভুল বলেছে। অতীতের ফলের সব চিত্রই সঠিক। তারপরও যদি তারা সঠিক মনে না করেন তাহলে এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।’
ফলের সার্বিক বিষয় নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সিআর আবরার বলেন, ‘এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল অনেককে বিস্মিত করেছে। পাসের হার এবং জিপিএ-৫ আগের বছরের তুলনায় কম এবং প্রশ্ন উঠেছেÑ কেন? এর উত্তর জটিল নয় বরং সহজ কিন্তু অস্বস্তিকর। বাংলাদেশে শেখার সংকট শুরু হয় খুব শুরুর দিকেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শেখার ঘাটতি তৈরি হয় এবং সেই ঘাটতি বছরের পর বছর সঞ্চিত হয়। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাইনি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিলÑ পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদ-। ফল ভালো দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। আমি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন