আমার সন্তানের লাশ মর্গের একপাশে পড়ে আছে। আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকব? আমার সন্তান সংসার চালাত। আমাদের সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে কখনোই ভাবিনিÑ কথাগুলো বলছিলেন তিন দিন আগে মিরপুরের অগ্নিকা-ে সন্তান হারানো বাবা মো. সুলতান মিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার লাশ শনাক্তের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে কাঁদছিলেন সুলতান মিয়া। হঠাৎ করে মর্গের খোঁজখবর নেওয়ার সময় এক ব্যক্তিকে কান্না করতে দেখা যায়। পরে দেখা যায়, সুলতান মিয়াই কান্না করছেন। এ সময় দেখা গেছে, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন আর আগুনে পুড়ে লাশ হয়ে আসা স্বজনের খোঁজ নিচ্ছেন।
মিরপুরের রূপনগর থানাধীন শিয়ালবাড়ি এলাকায় একটি পোশাক প্রিন্টিং কারখানায় গত মঙ্গলবার সকালে ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে পাশর্^বর্তী কারখানার রাসায়নিক গুদামে। এরপর প্রায় ২৮ ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সর্বশেষ কাজ করে ঘটনাস্থলে। ভয়াবহ এই আগুনের ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, যেহেতু এটা একটা কেমিক্যাল গোডাউন এবং এখানে প্রায় ছয়-সাত ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে। তা ছাড়া এখানে কোনো গাফিলতি বা নাশকতার সূত্র অথবা অন্য কোনো ধরনের সমস্যা ছিল কি নাÑ সেগুলোও মাথায় রেখে কাজ করছে তদন্ত কমিটি।
গতকাল বৃহস্পতিবার অগ্নিকা-ের ঘটনাস্থলে দেখা যায়, রূপনগরের কেমিক্যাল গোডাউন থেকে এখনো উঠছে ধোঁয়া। সেখানে উপস্থিত রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। অগ্নিকা-ের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন সবাই। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন আহত বা দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। যাদের অবস্থা মোটামুটি উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন চিকৎসকরা।
রূপনগরে আগুনের ঘটনায় ৭ সদস্যের কমিটি :
ভয়াবহ এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস থেকে ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ফায়ার সার্ভিস থেকে এক ক্ষুদে বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর। কমিটির সভাপতি হলেনÑ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপা. ও মেইন.) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ ছাড়া সদস্যরা হলেনÑ ড. মো. ইয়াছির আরাফাত খান (অধ্যাপক, রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়), অতীশ চাকমা (উপ-সহকারী পরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স), মো. সাইদুল আলম চৌধুরী (পিও কাম অ্যাডজুটেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স), সোহরাব হোসেন (ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স), মো. ফসির উদ্দিন (সিনিয়র স্টেশন অফিসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন) এবং সদস্য সচিব মো. ছালেহ উদ্দিন (উপপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা বিভাগ)।
ঘটনাটি নাশকতাও হতে পারে :
আগুনের ঘটনাস্থলের পাশের দোকানদার নয়ন মিয়া ও চায়ের দোকানি স্বপ্না রূপালী বাংলাদেশকে জানান, হঠাৎ বিকট শব্দ হলোÑ এরপরই বোমার মতো একের পর এক বিস্ফোরণ। প্রথমে বোমা বিস্ফোরণ ভেবেছিলাম। পরে দেখি প্রচুর ধোঁয়া। সেখানে সাধারণ মানুষের যাওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না। এরপর কিছু লোকজন বলছিল, এই ঘটনাটি নাশকতাও হতে পারে। তবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে নাশকতাও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যদি নাশকতা না হয় তাহলে এভাবে বোমার মতো বারবার শব্দ হবে কেন?
ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের একটি বিশেষ শাখার মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হলে জানান, এই ঘটনাটি আমার কাছেও মনে হচ্ছে পূর্বপরিকল্পিত। মালিক বা দায়িত্বশীলদের ধরতে পারলে আসল ঘটনা বের হয়ে আসবে। এদিকে আগুনের ঘটনাটি নাশকতা কি নাÑ সেটার দিকে নজর রেখে তদন্ত করছে সরকারের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দার সদস্যরা।
‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে মামলা :
মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় রাসায়নিক গুদামের মালিক শাহ আলম এবং ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুধবার রাতে নিহত একজনের পরিবারের পক্ষ থেকে এই মামলা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। মামলায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশের পল্লবী অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সালেহ মুহম্মদ জাকারিয়া এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, মামলায় যে দুজনকে আসামি করা হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে তারা পলাতক।
ঢাকা শহরে আগুনে মানুষ মরলেও আমাদের কোনো অনুভূতি নেই : মর্গে অভাগা মানুষগুলোর লাশের সারি দেখা যাচ্ছে। আমিও সেখানের শ্রমিক ছিলাম। আমাকে নিয়তি বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমাকে যখন ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার করে তখন দেখেছিলাম উৎসুক জনতার ভিড়। কিছু মানুষ আমাদের বাঁচাতে চাইছে আবার কিছু মানুষ দুর্ঘটনাস্থলে থেকে সেটা দু-চোখ দিয়ে উপভোগ করছে। তাদের দেখে মনে হলো, এই ঢাকা শহরে আগুনে পুড়ে মানুষ মরলেও সেটা নিয়ে আমাদের কোনো অনুভূতি নেই! খুব আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন মিরপুরের অগ্নিকা- থেকে বেঁচে আসা মো. নাজমুল। তিনি বলেন, আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিÑ সেখানে দেখলাম। মর্গে অভাগা মানুষগুলোর লাশের সারি। যেটা দেখে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে এবং আমাকে হতাশ করেছে। এর কারণ হলোÑ সেখানেও গিয়ে দেখি উৎসুক কিছু মানুষের ভিড়। এসব দেখেই আমার মনে হয়েছে যে, এই ঢাকা শহরের মানুষ আসলেই ভিন্নরকম। আগুনে পুড়ে মানুষ মরলেও সেটা নিয়ে আমাদের কোনো অনুভূতি নেই! দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা হয়তো ভুলে যাব।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন