চীনে আছে ২৪টি সৌর পদ। এর একটি ছিউ ফেন, যার মানে শরতের অর্ধেক পথ পেরিয়েছে প্রকৃতি। শীতল চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে মাঠে-ঘাটে, বাতাসে ভাসছে ওসমানথাস ফুলের ঘ্রাণ। এমন মিষ্টি মৌসুমই ফসল তোলার সময়Ñ সমৃদ্ধি আর উৎসবেরও।
এই মৌসুমেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে শানতোং প্রদেশের চাও ইউয়ান শহরের তাহু চেনচিয়া গ্রাম। আঙুরের বাগানে ঝুলতে দেখা যায় সবুজ ফল, বাগানে লাল টকটকে আপেল আর পাহাড়ের ঢালে মিষ্টি আলুর ছোট ছোট পাহাড়। চীনের কৃষকদের ফসল তোলা উৎসবের মূল অনুষ্ঠানটি হয় এখানেই। শুধু উৎসব নয়Ñ চীনের গ্রামগুলোয় যে নবপ্রাণের জোয়ার লেগেছে, সেই পুনরুজ্জীবনের এক অনন্য উদাহরণও এই তাহু চেনচিয়া।
আগে এখানকার মানুষ জীবিকার সন্ধানে শহরে যেত। কিন্তু সবাই চায় নিজ বাড়ি ঘিরেই থাকুক তাদের কাজ ও স্বপ্ন। তাই গ্রামের সিপিসি কমিটি ও স্থানীয় নেতৃত্ব একমত হয়Ñ আধুনিক কৃষিই হতে পারে এ স্বপ্ন পূরণের মূল পথ। তবে চ্যালেঞ্জটাও কম ছিল না। তাহু চেনচিয়ার মাটি ও আবহাওয়া কৃষির অনুকূলে ছিল না। আগে ভুট্টা ও চিনাবাদাম চাষ হলেও, চাষিদের আয় নির্ভর করত ভাগ্য আর বৃষ্টির ওপর।
সমাধান এলো নতুন ভাবনায়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আশপাশের ১২টি গ্রামকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় ৮০০ হেক্টর জমির সমবায়। এর মধ্যে আঙুর চাষের জন্য বরাদ্দ ছিল ২০০ হেক্টর। কৃষিবিজ্ঞান একাডেমির বিশেষজ্ঞরা ছয় মাসের গবেষণার পর শতাধিক জাতের মধ্যে বেছে নেন তিনটি সেরা আঙুর প্রজাতি। স্থানীয়রা শুরু করেন সেগুলোর চাষ।
এরপর চালু হয় স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা। বাগানগুলো লিজ দেওয়া হয় ৮০টি পারিবারিক খামারকে। কৃষি প্রযুক্তি ও বাজার নিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে সমবায় কমিটি সরবরাহ করে বিশেষজ্ঞ। এতে দূর হয়ে যায় কৃষকের যাবতীয় দুশ্চিন্তা। তাদের কাজ একটাইÑ বাগানের যতœ নিতে হবে ঠিকঠাক।
বিক্রিতেও আসে বৈচিত্র্য। পর্যটকরা নিজের হাতে আঙুর তোলার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন এখানে। সেই সূত্রে অনলাইন বিক্রিও চলে দারুণ গতিতে। একবারের লাইভ বিক্রিতে বিক্রি হয় দুই হাজার কেজিরও বেশি আঙুর।
এখন গ্রামের কৃষকরা শুধু ফসল ফলাচ্ছেন নাÑ তারা গড়ে তুলেছেন আঙুরভিত্তিক একটি শিল্পশৃঙ্খল। ফলের চাষ, রস সংগ্রহ বা ফল শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেই সঙ্গে পর্যটন ও ই-কমার্সÑ সবই চলছে একযোগে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা তাহু চেনচিয়া এখন চীনের জাতীয়-৩এ শ্রেণির পর্যটনকেন্দ্র। সবুজ পাহাড়, বহমান নদী, আর রংধনু স্লাইডের মতো মজার সব প্রকল্পের টানে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন এখানে। গত তিন বছরে শতাধিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন হয়েছে। বছরে গড়ে এ খাতে আয় ২০ লাখ ইউয়ানেরও বেশি।
এখন আউটডোর ক্যাম্পিং, স্থানীয় খাবার আর গ্রামীণ বাস্কেটবল লিগÑ সব মিলিয়ে গ্রামটি এখন স্থানীয়দেরও বিনোদনের কেন্দ্র।
তাহু চেনচিয়ার এই সাফল্য কেবল এক গ্রামের নয়Ñ এটি চীনের জন্য একটি ‘জানালা’, যা খুললেই দেখা যায় গ্রামের জেগে ওঠার বাস্তব চিত্র। চীনের এই গ্রামটি যেন গোটা বিশ্বকে শিখিয়েছেÑ বিশেষায়িত শিল্পের মাধ্যমে জমিকে সম্পদে রূপান্তর করতে হয় কীভাবে, কীভাবে জ্ঞান ও সংস্কৃতির মাধ্যমে গ্রামে প্রাণসঞ্চার ঘটাতে হয় এবং দরিদ্র পাহাড়ি গ্রামকে কী করে সোনার ভা-ার বানানো যায়।
লেখক: সংবাদকর্মী, সিএমজি বাংলা, বেইজিং
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন