দিনের বেলা সিলেটের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। রাতে সেই তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৩-এর কোটায় থাকছে। ফলে দেশের কোথাও কোথাও শীত নামতে শুরু করলেও সিলেটে চলছে তীব্র দাবদাহ। সেই সঙ্গে সিলেটবাসীর সঙ্গী হয়েছে ভয়াবহ বৈদ্যুতিক লোডশেডিং।
এভাবে একদিকে অসহনীয় লোডশেডিং, অন্যদিকে তীব্র গরমÑ এ দুয়ে মিলে সিলেটের জনজীবন এখন রীতিমতো অতিষ্ঠ। স্বাভাবিক কাজকর্মে ঘটছে চরম ব্যাঘাত। সবখানে নেমে এসেছে দুর্বিষহ অবস্থা।
সিলেটে এই মুহূর্তে লোডশেডিংয়ের মূল কারণ জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। গতকাল মঙ্গলবার সিলেটের বিভিন্ন উৎপাদনকেন্দ্র থেকে প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হলেও ঠিক সেই সময় সিলেট ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের শিকার হয়েছে। ১৯৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১২৫ মেগাওয়াট। পুরো সিলেট অঞ্চলে সরবরাহ ছিল সর্বোচ্চ ৭০০ মেগাওয়াট।
চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদনের পরও নামমাত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ করায় সিলেট এখন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মুখে উপনীত। জাতীয় গ্রিড থেকে উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য না রাখায় বঞ্চিত হচ্ছে সিলেট। শিকার হচ্ছে চরম বিদ্যুৎবৈষম্যের। বিমাতাসুলভ এই আচরণ নিয়ে ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে পুরো সিলেট। বিশেষ করে নগর সিলেটে লোডশেডিংয়ের অবস্থা এখন মাত্রাতিরিক্ত। দিনের প্রতি তিন ঘণ্টায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও দিনের প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাচ্ছে নগরবাসী।
বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, নগরীতে মঙ্গলবার ১৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে মাত্র ৬০ মেগাওয়াট। ৭০ মেগাওয়াট ঘাটতি নিয়ে সিলেট নগরে বিদ্যুৎসেবা দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবিকে। এদিকে শহরে বিদ্যুৎ বণ্টনেও বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগের আঙুল উঠেছে পিডিবির দিকে। দিনের বেলা শহরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফিডারে বিদ্যুৎ স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে অন্য এলাকা ও আবাসিক এলাকায় লোডশেডিং তীব্র করে তোলা হচ্ছে। প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর ৩০-৪০ মিনিট করে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে ওই সব এলাকায়। বাকি সময় চলছে লোডশেডিং।
সিলেটের বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ-স্বল্পতার প্রভাব পড়ছে সিলেটে। চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সিলেটে হলেও এ অঞ্চলকে অন্ধকারে রেখে সেখানকার বিদ্যুৎ অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে গ্রিড কন্ট্রোল বিভাগ। ঢাকা থেকেই সিলেটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে আনা হয়েছে। গরম কমে এলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে বলে জানান এক কর্মকর্তা।
সিলেটের বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সিলেটের সর্বত্রই দিনভর ঘনঘন লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। একেক এলাকায় দিনে-রাতে মিলে ২০ থেকে ২২ বারও লোডশেডিং করা হচ্ছে। বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলায় মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
জানা গেছে, গত রোববার ভোর থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সিলেট। মঙ্গলবার ভোর ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় ১৫-১৬ বার লোডশেডিং করা হয়। কোনো কোনো এলাকায় গড়ে ঘণ্টা দুয়েক বিদ্যুৎ ছিল।
এভাবে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। রান্না, গোসলসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের। একইভাবে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা ও উপশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় দিনভর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে। এমনকি সন্ধ্যায় ও রাতে লোডশেডিং হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। ফলে বন্দর বাজার এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অফিসে বড় প্রভাব পড়ছে। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে পুরো নগরীর বাসিন্দারা।
এ ব্যাপারে সিলেট পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মুহাম্মদ আব্দুল কাদির দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সিলেটে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা, সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জাতীয় গ্রিড থেকেই আমাদের জন্য বিদ্যুতের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
এদিকে সিলেট শহর ছাড়াও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এলাকায়ও লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। তবে শহরের তুলনায় তা অনেক কম। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-১ সূত্র জানায়, পিক আওয়ারে তাদের বিদ্যুতের চাহিদা ১১৫ মেগাওয়াট। কিন্তু এ সময় ৯০ মেগাওয়াটের মতো সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-২-এর এলাকায় পিক আওয়ারে চাহিদা ৫০ মেগাওয়াট। এ সময় তাদের গ্রিড থেকে সরবরাহ করা হয় ৩৫-৪০ মেগাওয়াট। সব সময় ১০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি রেখে সিলেট-২-এ বিদ্যুৎ সরবরাহ সেবা নিশ্চিত রাখতে হচ্ছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-১-এর জেনারেল ম্যনেজার আব্দুর রশিদ বলেন, ‘দিনের বেলায় আমাদের লোডশেডিং খানিকটা কম হয়, তবে রাতের বেলায় চাহিদা বেড়ে গেলে কিছুটা বিপত্তি ঘটে। তখন লোড ম্যানেজমেন্ট করে সামাল দিতে হয়।’
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-২-এর জেনারেল ম্যানেজার মো. রবিউল হক বলেন, ‘পিক আওয়ারে ১০ মেগাওয়াটের বেশি সংকট নিয়ে আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। এই সংকট মোকাবিলায় আমাদেরও লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’ তবে সেটি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে তার দাবি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন