মানুষের জীবন যেন এক বিশাল বাগান। সেই বাগানে বীজ বপন করলে যেমন ফুল ও ফল জন্মায়, ঠিক তেমনি তরুণ বয়সের প্রতিটি পদক্ষেপ ভবিষ্যতের বীজ হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি ভুল বীজ বপন করা হয়, তাহলে সেই বাগান একদিন আগাছায় ভরে যায়। আজকের বাস্তবতায় তরুণদের অনেকেই নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার পরিবর্তে ঝুঁকছে অনলাইন জুয়ার মতো এক ভয়াবহ আগাছার দিকে। অনলাইন জুয়া সাময়িক সাফল্য বা আনন্দ দিলেও ডেকে আনে দীর্ঘস্থায়ী প্রলয়। সাময়িক আনন্দের বশবর্তী হয়ে অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সুবিধার পাশাপাশি এসেছে এক মারাত্মক বিপদÑ অনলাইন জুয়া। মোবাইল ফোনের একটুখানি ক্লিকেই এখন কেউ সহজে বিভিন্ন বেটিং অ্যাপ বা গেম্বলিং সাইটে প্রবেশ করতে পারে। এই সহজলভ্যতাই হাজারো তরুণের ভবিষ্যৎকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি খুলে দিয়েছে এক ভয়াবহ ফাঁদ। বর্তমানে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে অনলাইন জুয়া এক অদৃশ্য মহামারি হয়ে উঠেছে। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় তরুণরা রাত জেগে ক্রিকেট বেটিং, ক্যাসিনো গেম কিংবা বিভিন্ন অনলাইন বেটিং অ্যাপে মত্ত হয়ে পড়ছে। প্রাথমিকভাবে তারা জুয়া খেলাকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও একটা সময় টাকার নেশা তাদেরকে পাগল করে দেয়। তারা মনে করে জুয়া খেলে তারা সফল হচ্ছে তবে একটা সময় হারতে হারতে সব টাকাই হেরে ফেলে। কেউ কেউ নেশায় পরে মূল্যবান সম্পদ বিক্রি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, নেশাজাতীয় অন্যান্য দ্রব্য বেচাকেনার মতো ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পরে। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, পরিবার সবকিছু উপেক্ষা করে এই নেশা তাদের জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, সময় ও সম্ভাবনা।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের তরুণদের বড় একটি অংশ অনলাইন জুয়ার নেশায় আসক্ত। একাধিক শিক্ষার্থী তাদের মেসের ভাড়া বা টিউশনের টাকা পর্যন্ত বেটিংয়ে হারিয়ে ফেলে হতাশায় ভুগছে। নিজেদের খরচের টাকা, পরিচিতদের থেকে ঋণ নেওয়া টাকা, অসাধু উপায়ে উপার্জন করা টাকা সব যেন গ্রাস করছে অনলাইন জুয়ার নেশা। প্রথমত তারা একবার চেষ্টা করার জন্য অনলাইনে জুয়া খেলে। তারপর যখন জিতে যায় তখন তাদের লোভ আরও বৃদ্ধি পায়। তারা আরও টাকা উপার্জনের আশায় আবারও জুয়া খেলে। এভাবে চলতে থাকে তাদের জুয়া খেলা। হঠাৎ কয়েকশ হেরে গেলে তারা তা স্বাভাবিক মনে করে। পরে কয়েক হাজার হারলে তারা জিতার নেশায় আরও খেলা শুরু করে। এভাবে তাদের নিজের টাকা এবং অন্যের থেকে নেওয়া ঋণের টাকা সব শেষ হয়। তবুও সাফল্য আসে না। শেষ পথ হিসেবে তারা আত্মহত্যা বেঁছে নেয়।
অনলাইন জুয়ার প্রতি তরুণরা দিন দিন আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। তরুণদের আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম সহজ প্রলোভন। একটি ছোট অঙ্কের টাকা দিয়ে মুহূর্তেই দ্বিগুণ বা কয়েকগুণ পাওয়ার লোভ তাদের অনলাইন জুয়ার প্রতি আকৃষ্ট করছে। লোভের বশবর্তী হয়ে তারা ভুলে যায় এর ফলাফল কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। বেকারত্ব ও হতাশার কারণে অনেক তরুণ চাকরি না পেয়ে বা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দ্রুত টাকা আয়ের সহজ পথ খুঁজে নেয়। স্নাতক পাস করা একজন ছেলের যাবতীয় সকল খরচের দায়ভার পরে তার ওপরে। ফলে তারা টাকা উপার্জনের নানা পন্থা খুঁজে বেড়ায়। অনেক সময় খারাপ বন্ধুদের প্রভাবেও প্রথমবার বেটিং শুরু হয় এবং পরে তা নেশায় পরিণত হয়। আইন প্রয়োগে দুর্বলতা অনলাইন জুয়ায় আসক্তির সবচেয়ে বড় কারণ। যদিও বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া অবৈধ, তবুও ভিপিএন বা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে অনায়াসে খেলা সম্ভব হচ্ছে। সামাজিক সচেতনতার অভাবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক সময় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করে না।
নিত্যদিন তরুণ সমাজের মাঝে বেড়ে চলা অনলাইন জুয়ায় আসক্তির এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শুরুতেই কঠোর আইন প্রয়োগ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অনলাইন বেটিং অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করার পাশাপাশি ঠচঘ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সকলের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুল-কলেজে অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে সেমিনার আয়োজন করা দরকার। পরিবারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বাবা-মা সন্তানের মোবাইল ব্যবহার ও অনলাইন কার্যক্রমে নজরদারি করতে পারেন। তরুণ সমাজের জন্য বিকল্প বিনোদন যেমন: খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও সৃজনশীল কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। কাউন্সেলিং সেবার আয়োজন করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি। যারা ইতোমধ্যেই আসক্ত, তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা করা জরুরি।
রাষ্ট্রের এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা অনুপস্থিত। তরুণ প্রজন্মের এমন অধপতন যেন সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বার্তা বয়ে আনে। যে রাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী সে রাষ্ট্রের প্রতি উন্নয়নে অংশ নেওয়া অসম্ভব হয়ে পরে। তাই সরকারের উচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কেননা আজকের তরুণরা আগামীর ভবিষ্যৎ। আমাদের রাষ্ট্রই নয় বরং বিশ্বব্যাপী তরুণরা যে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে তা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলের জন্য ভয়াবহ দিকে পরিণত হচ্ছে।
অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের সচেতন মানুষদের এখনই এগিয়ে আসতে হবে। তরুণদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ ও ডিজিটাল সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। মনে রাখতে হবেÑ একটি মোবাইল স্ক্রিনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অন্ধকার জগৎ, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রাস করতে চায়।
অনলাইন জুয়া কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি পুরো সমাজের জন্য এক বড় হুমকি। কারণ আজকের তরুণরাই আগামী দিনের রাষ্ট্র ও জাতির চালিকাশক্তি। তাদের যদি অনলাইন জুয়ার ফাঁদে আটকে ফেলা যায়, তাহলে দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। তরুণদের হাত ধরে এগিয়ে চলে আমাদের রাষ্ট্র, সেখানে তরুণরা বিপথগামী হওয়া মানে সমগ্র রাষ্ট্র বিপথে যাওয়া। তাই আমাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনলাইন জুয়ার আসক্তি নিরসন করতে হবে। যাতে করে দেশ ও দশের সার্বিক মঙ্গল সাধন সম্ভব হয়। শুধু সরকারের পদক্ষেপ নয়, প্রত্যেক পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি গণমাধ্যমকেও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। অনলাইন জুয়া হয়তো মুহূর্তের আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু তা চিরকালীন অন্ধকার ডেকে আনে। যে সময়টা পড়াশোনা, পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম, কর্মদক্ষতা বা স্বপ্ন গড়ার জন্য ব্যয় করা দরকার, সেই সময়টা যদি নষ্ট হয় জুয়ার নেশায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে।
নুসরাত জাহান (স্মরণীকা)
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন