শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


তামান্না ইসলাম

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৫, ০১:২৩ এএম

বাল্যবিবাহ; স্বপ্নের বয়সে সংসারের বোঝা

তামান্না ইসলাম

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৫, ০১:২৩ এএম

বাল্যবিবাহ; স্বপ্নের বয়সে সংসারের বোঝা

শৈশব ও কৈশোরের সীমানা পেরোতে না পেরোতেই যখন একটি মেয়েকে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য করা হয়, তখন তা তার জীবনের ওপর অন্ধকার ফেলে দেয়। এটি একটি মেয়ের সমস্ত সম্ভাবনার দরজা বন্ধ করে দেয়।

বাল্যবিবাহ হলো মেয়েদের ১৮ বছর বয়স আর ছেলেদের ২১ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী এটা বেআইনি। কিন্তু অনেক জায়গায় এই আইন মানা হয় না। বাল্যবিবাহ শুধু একটা সমস্যা নয়, এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়। বাংলাদেশে এই সংখ্যা এখনো অনেক বেশি।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কমলেও এটি এখনো একটি বড় সমস্যা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সের আগে। আর ১৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং গরিব পরিবারে এই হার অনেক বেশি। দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক রীতিনীতির চাপে অনেক পরিবারই মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। অনেক বাবা-মা মনে করেন, মেয়ের বিয়ে দিলেই যেন দায়িত্ব শেষ। গরিব পরিবারে মেয়েকে বোঝা মনে করা হয় এবং তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায় তারা। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না- এভাবে তারা তাদের সন্তানের শৈশব, লেখাপড়া এবং ভবিষ্যৎ সব নষ্ট করে দিচ্ছেন।

বাল্যবিবাহের পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, সামাজিক কুসংস্কার একটা বড় কারণ। সমাজের অনেকে এখনো মনে করেন, মেয়েদের বেশি দিন অবিবাহিতা রাখলে পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়। কিছু এলাকায় মেয়েদের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। যৌতুকের ভয়ও কাজ করে-মেয়ের বয়স বাড়লে যৌতুক বাড়ে, এই চিন্তা থেকেও তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য একটা মূল কারণ। গরিব পরিবারে মেয়ের খরচ চালাতে পারে না বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়। তৃতীয়ত, মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব। অনেক জায়গায় মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না নিরাপত্তার অভাবে। যৌন হয়রানির ভয়ে বাবা-মা মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা বা কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির সময়েও বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়। স্কুল বন্ধ থাকলে এবং আর্থিক সংকট বাড়লে পরিবারগুলো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়।

এবং পিতামাতার শিক্ষার অভাব। যেসব বাবা-মা নিজেরা শিক্ষিত নন, তারা মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন না। তারা নিজেরা যেভাবে বড় হয়েছেন, সেই পুরোনো ধারণা নিয়েই চলেন। তাদের কাছে মেয়েদের লেখাপড়ার চেয়ে বিয়ে বেশি জরুরি মনে হয়।

বাল্যবিবাহের ফলে একটি মেয়ের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে বয়সে তার পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করার কথা, সে বয়সেই তাকে সংসার সামলাতে হয়। ছোট বয়সে মা হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি। ১৮ বছরের আগে গর্ভধারণ করলে মা ও শিশু দুজনেরই প্রাণনাশের ভয় থাকে। প্রসবের সময় রক্তক্ষরণ, অপুষ্টি এবং নানা জটিলতা দেখা দেয়।

ছোট বয়সে মা হলে মেয়েদের শরীর সেই ঝুঁকি নিতে পারে না। তাদের নিজেদের শরীর তখনো পুরোপুরি বিকশিত হয় না। তাই গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের সময় নানা জটিলতা দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে মা বা শিশু অথবা উভয়েই মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে তারাও সারাজীবন নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে।

শুধু শরীরের ক্ষতি নয়, মনেরও অনেক ক্ষতি হয়। ছোট বয়সে বিয়ে হলে মেয়েরা মানসিক চাপ, হতাশা এবং একাকিত্বে ভোগে। অনেক সময় স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির মানুষের অত্যাচারও সহ্য করতে হয়।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বই-খাতার জায়গায় নেয় রান্নাঘর আর স্বপ্নের জায়গা নেয় সংসারের রুটিন। স্বপ্ন দেখার সুযোগ থাকে না। যে মেয়েটি পড়াশোনা করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক হতে পারত, সে হয়ে পড়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল।

বাল্যবিবাহ শুধু একজন মেয়ের জীবনকে নয়, পুরো সমাজকেও পিছিয়ে দেয়। যে মেয়েটি শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারত, সে সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সরকার কঠোর আইন করেছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী বাল্যবিবাহ করলে শাস্তি হবে। সরকারি একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী-২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার লক্ষ্য রয়েছে।

স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে এবং বিনা মূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও যেমন ব্র্যাক, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, সেভ দ্য চিলড্রেন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বাল্যবিবাহের ক্ষতি সম্পর্কে বোঝাচ্ছে।

কিন্তু শুধু আইন বা সাহায্য দিয়ে এই সমস্যা সমাধান হবে না। মানুষের মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমত, মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাই হলো মেয়েদের সবচেয়ে বড় শক্তি। যত বেশি মেয়ে পড়াশোনা করবে, ততই তারা নিজেদের অধিকার বুঝবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি।

দ্বিতীয়ত, পরিবারগুলোকে বোঝাতে হবে যে বাল্যবিবাহ মেয়ের ভালো করে না, বরং তার জীবন নষ্ট করে। গ্রামে গ্রামে সভা করে, নাটক দেখিয়ে, পোস্টার লাগিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। ইমাম, পুরোহিত, গ্রামের মাতব্বরদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

তৃতীয়ত, সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবেশী, আত্মীয়, শিক্ষক-সবাই যদি একসঙ্গে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তবেই পরিবর্তন সম্ভব। কেউ যদি বাল্যবিবাহের খবর পায়, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনকে জানাতে হবে। চতুর্থত, টিভি, সিনেমা, নাটকে বাল্যবিবাহের ক্ষতি দেখাতে হবে। ফেসবুক, ইউটিউবেও এ নিয়ে প্রচার করতে হবে। যত বেশি মানুষ জানবে, ততই সচেতনতা বাড়বে। পঞ্চমত, গরিব পরিবারগুলোকে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যাতে তারা অর্থের অভাবে মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য না হয়। ক্ষুদ্র ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং চাকরির সুযোগ দিতে হবে।

আবার, মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। তাদের জানাতে হবে যে তারা কোনো বোঝা নয়, বরং সম্পদ। তারা যেকোনো কাজে ছেলেদের চেয়ে কম নয়। মেয়েদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। যখন একটি মেয়ে দেখবে যে সে অনেক কিছু করতে পারে, তখন সে নিজের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হবে।

এবং ছেলেদেরও শিক্ষিত ও সচেতন করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে যে মেয়েদের সম্মান করতে, তাদের স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করতে। ছেলেদের মধ্যেও যদি সচেতনতা তৈরি হয়, তাহলে তারা নিজেরাই বাল্যবিবাহ প্রত্যাখ্যান করবে। একজন শিক্ষিত ছেলে কখনো অল্প বয়সি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে না।

একটি মেয়েকে তার স্বপ্ন দেখার এবং সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দিতে হবে। তাকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে না দিয়ে, তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য গড়ার অধিকার দিতে হবে। প্রতিটি মেয়েই একটি সম্ভাবনা, একটি শক্তি-যাকে দমিয়ে রাখা নয়, বিকশিত করাই আমাদের দায়িত্ব। কঠোর আইন প্রয়োগ, শিক্ষার বিস্তার, আর্থিক উন্নয়ন এবং মানসিকতার পরিবর্তনÑ এই সবকিছু মিলেই সম্ভব বাল্যবিবাহমুক্ত বাংলাদেশ গড়া।

তামান্না ইসলাম, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!