মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অবৈধ অনলাইন জুয়ার লেনদেন প্রতিরোধে সব এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এমএফএস অপারেটররা বলছেন, এসব লেনদেনের ধরন শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। তারা বলছেন, পার্সন-টু-পার্সন লেনদেনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সহজে নির্ণয় করা যায় না। অন্যদিকে কিছু এজেন্ট বা মার্চেন্ট একাধিক স্তরের স্থানান্তরের মাধ্যমে এমএফএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জুয়ার সাইটগুলোতে বড় অঙ্কের টাকা পাচার করতে পারে, যা ট্র্যাক করা আরও কঠিন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি দেশের ১৩টি এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে।
এমএফএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অবৈধ জুয়ার মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে বলে সতর্ক করে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টগুলোর তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চিঠিতে সব এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে টাস্কফোর্স গঠন করতে ও এআইযুক্ত স্বয়ংক্রিয় মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জুয়াসংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্য পাবলিক রিপোর্টিং পোর্টাল ও হেল্পলাইন চালুর নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, জুয়াসংক্রান্ত লেনদেন প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামীকাল বৃহস্পতিবার সাতটি এমএফএস অপারেটরের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা করেছে। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে দেশ থেকে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনো সংস্থার কাছে নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই অঙ্ক প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ইতোমধ্যে দেশে পরিচালিত সব জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে জুয়া খেলা অব্যাহত রয়েছে। বিটিআরসির প্রচেষ্টার পাশাপাশি ব্যাংক ও এমএফএস প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই ধরনের লেনদেন হচ্ছে কি নাÑ তা মনিটরিংয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর অবস্থান নেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, এমএফএসের মাধ্যমে কিছু এজেন্ট পয়েন্ট বা মার্চেন্ট সরাসরি জুয়ার সাইটে সেই অর্থ পরিশোধ করতে পারে। জুয়াড়িরা তাদের টাকায় অর্থ পরিশোধ করে। এই টাকাকে ডলারে রূপান্তর করতে তারা হয়তো বেশি রেট দেয় এবং লেনদেনগুলো একাধিক স্তরের মাধ্যমে দিয়ে পরিচালিত হয়। ফলে প্রতিদিনের বড় অঙ্কের লেনদেন ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে পড়ে।
একজন সাবেক পেশাদার জুয়ারির সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, দেশ থেকেই বেটিং অ্যাপে প্রোফাইল তৈরি করে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। সব ধরনের খেলাতেই বাজি ধরা যায়। যে খেলায় যার অভিজ্ঞতা বেশি, তিনি ওইসব খেলায় বেটিং করেন। তিনি আরও বলেন, মূলত যিনি অনলাইনে জুয়া খেলতে আগ্রহী, তিনি বেটিং অ্যাপে গিয়ে একটি প্রোফাইল খুলবেন। বেটিং অ্যাপ থেকে এমএফএসের একটি বিজনেস অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়। সেই বিজনেস অ্যাকাউন্টে আরেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠাতে হয়। আবার বেটিং শেষ হলে টাকা জিতলে টাকা উত্তোলন করে ফেলেন।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, আজ পর্যন্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যেসব জুয়া সংঘটিত হয়েছে, নিঃসন্দেহে সেগুলোর লেনদেন হয়েছে এমএফএসের মাধ্যমে; ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এগুলো লেনদেন হয় না। আমি এ পর্যন্ত উদাহরণ পাইনি। এ জন্য যেসব এমএফএস অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক টাকা আসছে, সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা উচিত। দুই-চারজন ধরা পড়লে বাকি যারা এদের মাধ্যমে একটা চেইন গঠন করেছে, তাদেরও ট্র্যাক করা যাবে। এরপর আরও ধরা যাবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে একটা মনিটরিং দল গঠন করতে বলা হয়েছে। তা আরও আগেই করা উচিত ছিল। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি হলো, তখনই এটা করা উচিত ছিল।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংক ও এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব লেনদেন হচ্ছে তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তা ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে, তাদের একটা মনিটরিং দল থাকা উচিত যেন এমন সন্দেহজনক লেনদেন হলে তা শনাক্ত করতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘কোথায় এ ধরনের লেনদেন হচ্ছে, তা ট্র্যাক করার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের। বিশেষ করে জুয়াসংক্রান্ত লেনদেন ব্যাংক ও এমএফএসকে শনাক্ত করতে হবে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন