সুদানের বালুকাময় প্রান্তরে পথের ধারে পড়ে আছে ৯টি মরদেহ। অস্তমিত সূর্যের দিকে ছুটছে একটি পিকআপ ট্রাক। এর পেছনে চেপে হাসতে হাসতে যাচ্ছেন যোদ্ধারা। হঠাৎ একজনের উল্লাস, ‘কাজটা দেখ, গণহত্যাটা দেখ।’ হাসতে হাসতে সে যখন ক্যামেরা নিজের ও সহযোদ্ধাদের দিকে ঘোরায়, তখন দেখা যায়, তাদের গায়ে ঝুলছে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) ব্যাজ। সে বলে, ‘ওরা সবাই এভাবেই মরবে।’ বিবিসি বলছে, এই লোকগুলো এমন এক গণহত্যা উদযাপন করছিলেন, যেখানে মানবাধিকার কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, গত মাসে সুদানের এল-ফাশের শহরে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) জানিয়েছে, এই আধাসামরিক বাহিনী ‘যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ করেছে কি না, তা তারা খতিয়ে দেখছে। এল-ফাশের ছিল আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফের প্রধান লক্ষ্য। এটি দারফুর অঞ্চলে সুদানি সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটি ছিলÑ যাদের সঙ্গে ২০২৩ সালে ক্ষমতাসীন জোট ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আরএসএফ ভয়াবহ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েও সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে শুক্রবার রাতেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এ ঘটনার এক দিন আগে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) জানিয়েছিল, মানবিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে তারা। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা খার্তুমে বসবাসকারীরা এএফপিকে জানিয়েছে, তারা রাতে ড্রোন ও বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলেন। বাসিন্দারা বলেন, শুক্রবার ভোরের দিকে বিস্ফোরণগুলো একটি সামরিক ঘাঁটি এবং একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে সংঘটিত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। আরএসএফ এসব ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে সুদানের সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকার জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতি নিয়ে সতর্ক থাকবে, কারণ এ গোষ্ঠী ‘বিরতি মানে না’। গত দুই বছরে এই সংঘাতে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই রয়েছে অসংখ্য যুদ্ধাপরাধের অভিযোগÑ যার অনেকই এল-ফাশের পতনের পর পুনরায় ঘটিয়েছে আরএসএফ। প্রায় দুই বছর অবরুদ্ধ রাখার পর, গত আগস্টে আরএসএফ শহরটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও অবশিষ্ট বেসামরিক জনগণকে অবরুদ্ধ করার পদক্ষেপ নেয়। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, সেনারা শহরটির চারপাশে একটি বিশাল বালুর বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, সব প্রবেশপথ ও সাহায্য সরবরাহও বন্ধ করে দেয়। অক্টোবরের শুরুর দিকেই পুরো শহরটি ওই বালুর বৃত্তে ঘেরা পড়েÑ পাশের একটি গ্রামকেও ছোট ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়।
অবরোধ আরও তীব্র হওয়ার পর ১৯ সেপ্টেম্বর এক মসজিদে আরএসএফের হামলায় ৭৮ জন নিহত হন। জাতিসংঘ জানায়, অক্টোবরে এক বাস্তুচ্যুত শিবিরে ড্রোন ও কামান হামলায় আরও ৫৩ জন প্রাণ হারান। বিবিসির হাতে আসা ভিডিওগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, আরএসএফ খাদ্য ও জরুরি সামগ্রীর অবরোধ আরোপ করেছিল।
অক্টোবরের এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে হাত-পা বেঁধে গাছ থেকে শেকল দিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ভিডিও ধারণকারীর অভিযোগ, ওই ব্যক্তি নাকি অবরুদ্ধ শহরে জরুরি সামগ্রী পাচারের চেষ্টা করছিলেন।’ আমি কসম করে বলছি, এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে, কুকুর’Ñ চিৎকার করে বলল সে, তারপর বন্দিকে প্রাণভিক্ষা চাইতে বাধ্য করল। অপরদিকে, আরএসএফ সেনারা শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রাস্তায় রাস্তায় উন্মত্ত লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ২৬ অক্টোবর ভোরে সেনাবাহিনী পিছিয়ে পড়লে আরএসএফ শহরের শেষ সামরিক স্থাপনাটি দখল করে নেয় এবং ষষ্ঠ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সদর দপ্তরসহ প্রধান ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দারফুরে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যার জন্য দায়ী জানজাবিদ মিলিশিয়া থেকে গঠিত আরএসএফ দীর্ঘদিন ধরেই সুদানের অ-আরব জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজ ইঙ্গিত দেয়, এই আধাসামরিক বাহিনী এল-ফাশেরের সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ সহিংসতা চালিয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন