ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের ১৩ নভেম্বর ঢাকায় লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণাসহ জুলাই আন্দোলনের সহিংসতা মামলার রায় ঘোষণা সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, দখল ও হত্যার ঘটনা ঘটছে, তা জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ নানা এলাকায় গুলি, বিস্ফোরণ ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করছে, সহিংস রাজনীতির পুরোনো ছাঁয়া আবার ফিরে এসেছে। নির্বাচনের আগে এমন অরাজকতা কেবল রাজনৈতিক পরিবেশ নয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতার মূল কারণ রাজনৈতিক দখল, দলীয় কোন্দল, মনোনয়ন সংক্রান্ত বিরোধ এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিনে মুক্তি পাওয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র প্রবেশের ঘটনা। এসবের ফলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠছে। এমন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্ব আরও বাড়ছে।
সহিংসতা দমনে শুধু পুলিশের অভিযান চালানোই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কঠোর আইনি পদক্ষেপের। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমঝোতা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে না আনলে অস্থিতিশীলতা বাড়তেই থাকবে। তবে যেভাবেই হোক, নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-কে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যারা মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ বা ভোটবিরোধী সহিংসতায় জড়িত, তাদের দলীয় পরিচয় না দেখে আইনের আওতায় আনতেই হবে।
লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে সরকারের পুরস্কার ঘোষণার উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও এর ফল এখনো আশানুরূপ নয়। এসব অস্ত্র উদ্ধারই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের প্রথম শর্ত। পাশাপাশি জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর কড়া নজরদারি ও প্রয়োজনে বিশেষ অভিযান চালানো জরুরি। নির্বাচনকে ঘিরে কোনো গোষ্ঠী যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারেÑ সে ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ ও দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। নাশকতা দমনে আইন প্রয়োগে গাফিলতি বা রাজনৈতিক প্রভাব চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ নির্বাচন প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ সহিংসতার রাজনৈতিক মূলে রয়েছে শক্তি-প্রতিষ্ঠার লোভ, প্রতিশোধপরায়ণতা ও দলীয় আধিপত্যের লংঘন। এককভাবে পুলিশি শক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ মীমাংসায় দায়শীলতা নিতে হবে, মনোনয়ন, কমিটি গঠন ও নেতৃত্ব নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সমঝোতা ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সংলাপ ও দ্বিপক্ষীয় আস্থা পুনঃস্থাপন করা ছাড়া সহিংসতা ঠেকানো কঠিন।
এই সংকটে দেশের নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রমাণভিত্তিক রিপোর্টিং এবং দায়ী ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় উদ্ঘাটনে সক্রিয়তা রাখতে হবে। তদুপরি, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় কমিউনিটি লেভেলে শান্তি ও সহনশীলতা প্রচার জরুরি। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া আর মাত্র রাজনৈতিক কমিশন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একক প্রচেষ্টা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আনতে সক্ষম হবে না।
রাষ্ট্রকে বলব নিরাপত্তা ও সংহতির প্রশ্নে কোনো আপস করা চলবে না। নির্বাচনি পরিবেশকে সুষ্ঠু ও নিরাপদ রাখাই গণতন্ত্র রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। যারা নাশকতা ছড়ায়, জনজীবন ধ্বংস করে, সেগুলোকে আইনের সর্বোচ্চ মাপকাঠিতে দ-িত করতে হবে।
এই সংকট মোকাবিলায় একক ফর্মুলা নেই। প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। নাশকতা দমন করাই হবে রাষ্ট্রের কর্তব্য। দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রাখতে নাশকতা কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন।
আমরা মনে করি, জনগণের জানমাল রক্ষা করা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে সরকারকে দৃঢ়, ন্যায়সঙ্গত ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে হবে। সহিংস রাজনীতির অন্ধকার থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনতে হলে সব ধরনের নাশকতা কঠোর হাতে দমন করার কোনো বিকল্প নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন