‘সকাল থেকে তাঁবুতে বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বৃষ্টির পানিতে আমাদের সব কাপড়, এমনকি তোশকটাও ভিজে গেছে।’ বলেন গাজার একটি শিবিরে পানি সরানোর চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত নিভেন আবু জ্রেইনা।
মৌসুমের প্রথম ভারি বৃষ্টিতে গাজার অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরগুলো প্লাবিত হয়েছে। হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে, ভিজে গেছে তাদের কাপড়, তোশক ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সিভিল ডিফেন্স শত শত সাহায্যের আবেদন পেয়েছে, তবে সীমিত সামর্থ্য ও ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে পর্যাপ্ত সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।
রোববারের বৃষ্টিতে গাজার বহু নিচু এলাকা হাঁটুপানিতে ডুবে গেছে। শিশুদের গোড়ালি সমান জল পেরিয়ে হাঁটাচলা করতে দেখা গেছে। বাস্তুচ্যুতদের নিয়ে কাজ করা ইনাম আল-বাট্রিখি বলেন, ‘নারীরা যখন সাহায্যের জন্য আমার কাছে আসে, নিজেকে অসহায় মনে হয়। আমার নিজের তাঁবুতেও পানি ঢুকছে।’ আরেক বাস্তুচ্যুত নারী নুরা আবু এল-কাশ বলেন, ‘আজকের বৃষ্টিতে আমার তোশক, কম্বল, কাপড় সব ভিজে গেছে। এই জায়গা আমাদের রক্ষা করতে পারছে না। এখন আমি কী করব?’
মৌসুমের প্রথম বড় ধরনের বৃষ্টিপাতেই ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছে গাজা উপত্যকার অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরগুলো। শুক্রবার রাতে শুরু হওয়া ভারি বৃষ্টিতে হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবু প্লাবিত হয়ে ভিজে গেছে কাপড়, কম্বল, তোশকসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
গাজা সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, কয়েক হাজার মানুষ অস্থায়ী তাঁবুতে থাকছে, কিন্তু ভারি বৃষ্টির কারণে সেগুলোতে ব্যাপক পানি ঢুকেছে। শনিবার ভোর থেকেই সংস্থাটি শত শত সাহায্যের আবেদন পেয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘যাদের তাঁবু নষ্ট হয়েছে, তাদের সবার জন্য পর্যাপ্ত নতুন তাঁবু আমাদের কাছে নেই।’
গাজা উপত্যকায় শরতের শেষ ও শীতকালে সাধারণত বৃষ্টি বেশি হয়। কিন্তু মানবিক পণ্য সরবরাহে ইসরায়েলি বিধিনিষেধের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের ব্যবহৃত তাঁবুগুলো বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অক্ষম। এমনকি একটি তাঁবু স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ‘টেন্ট পোল’ পর্যন্ত গাজায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার ৯২ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত, ফলে আশ্রয়ের সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
গাজায় রাতের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করে, কিন্তু যথেষ্ট আশ্রয়, খাবার ও উষ্ণতার অভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য এটি নেমে আসে অসহনীয় কষ্টে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিসে ভারি বর্ষণের ফলে শরণার্থী শিবিরের বহু তাঁবু জলমগ্ন হয়ে গেছে। ফলে দুর্দশা আরও বেড়ে গেছে ঘরছাড়া ফিলিস্তিনিদের। রোববার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা আনাদোলু। গাজা সিভিল ডিফেন্স এক বিবৃতিতে জানায়, পশ্চিম খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় তাদের টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। এই এলাকায় বর্ষণের পানিতে ভেসে গেছে বহু শরণার্থী শিবিরের তাঁবু। গত শুক্রবার থেকে নি¤œচাপের প্রভাবে গাজা উপত্যকায় ঠান্ডা হাওয়া ও ভারি বর্ষণ দেখা গেছে, যা ১৫ লাখ শরণার্থীর দুর্দশা আরও বাড়িয়েছে। গাজার মিডিয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার তাঁবুর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার বা ৯৩ শতাংশই আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং ইসরায়েলের বিমানবাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁবুগুলো। ইসরায়েল এখনো তাঁবু ও মোবাইল হোমসহ আশ্রয়সামগ্রী প্রবেশ করতে দিচ্ছে না উপত্যকায়। যদিও ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর শান্তিচুক্তির আওতায় বাধা দেওয়ার এখতিয়ার নেই তাদের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই পরিকল্পনায় গাজা পুনর্গঠন এবং হামাস ছাড়া একটি নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ৬৯ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
গাজায় ভারি বৃষ্টিতে অস্থায়ী শিবিরে বসবাসরত ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টিতে পানি জমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপর্যাপ্ত তাঁবু ও আশ্রয়ের অভাব শীতকালকে ঘিরে তাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
শনিবার দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসে কয়েক ডজন তাঁবু বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়। বাসিন্দা আব্দুর রহমান আসালিয়া জানান, শিবিরের থাকার জায়গা, কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র পানিতে ভিজে গেছে। পানি নিষ্কাশনে কয়েক ঘণ্টা ধরে অসংখ্য মানুষ কাজ করেছে। আসালিয়া বলেন, ‘আমাদের আরও সাহায্য প্রয়োজন, নতুন তাঁবুর ব্যবস্থা চাই, যা মানুষকে অন্তত শীতের ঠান্ডা থেকে রক্ষা করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, শীতকালীন বৃষ্টি আল্লাহর আশীর্বাদ, তবে এমন কিছু পরিবার আছে, যারা আর বৃষ্টি চাইছে না। তারা সন্তানদের ও নিজের জীবন নিয়ে চিন্তিত। গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, শুক্রবারের বন্যায় মূলত উপত্যকার উত্তরের অংশের ফিলিস্তিনিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অঞ্চলে গত মাসে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তিচুক্তির পরে হাজার হাজার মানুষ ফিরে এসেছে।
ইসরায়েল এখনো তাঁবু, মোবাইল হোম ও অন্যান্য আশ্রয়সামগ্রী প্রবেশে বাধা দিচ্ছে, যা গত ১০ অক্টোবর কার্যকর হওয়া শান্তিচুক্তির লঙ্ঘন। গাজার বন্যা ও ইসরায়েলের প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞার ফলে ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির নিরাপত্তা, আশ্রয় ও পুনর্বাসন নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আগামী সপ্তাহে একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করবেন, যার আওতায় গাজার ৩ হাজার ফিলিস্তিনি পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব নিতে পারে ইইউ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে। আগামী ২০ নভেম্বর মন্ত্রীদের বৈঠকের আগে ইইউর কূটনৈতিক দপ্তর যে নথি তৈরি করেছে, তাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত গাজাবিষয়ক ২০ দফা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইইউ কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস অক্টোবর মাসে ওই পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছিল। তবে বাকি ধাপগুলো বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
নথিতে বলা হয়, সীমান্ত সহায়তা এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার সংস্কারকে সমর্থন করে এমন ইইউর দুটি বেসামরিক মিশন আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইইউর পুলিশ সহায়তা মিশন চাইলে গাজায় প্রায় ৩ হাজার পুলিশ সদস্যকে সরাসরি প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিতে নেতৃত্ব নিতে পারে। পরবর্তীতে গাজার পুরো ১৩ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণের লক্ষ্যও রয়েছে।
এরই মধ্যে রাশিয়া গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে নিজস্ব গাজাসংক্রান্ত প্রস্তাব দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন করানো নিয়ে চলমান প্রচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। যুদ্ধবিরতির চুক্তির অংশ হিসেবে ১৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। শনিবার হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। গাজা সিটি থেকে এএফপি এ খবর জানায়। মন্ত্রণালয়টি জানায়, শুক্রবার ইসরায়েলি বাহিনী রেডক্রসের মাধ্যমে মরদেহগুলো ফেরত দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী গতকাল শুক্রবার রেডক্রসের মাধ্যমে ১৫ শহিদের মরদেহ হস্তান্তর করেছে। এ নিয়ে মোট ৩৩০টি মরদেহ পাওয়া গেছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন