আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলয়ের বাইরে আরেকটি নতুন নির্বাচনি জোট আত্মপ্রকাশের জোর গুঞ্জন উঠেছে। যেখানে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) পাশে চাইছে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো। আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশসহ আরও কিছু দল এনসিপিকে নিয়ে গঠন করতে চায় নতুন এই জোট। চেষ্টা চলমান থাকলেও জোটের ধরন বা নামের বিষয়ে চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জোটের বিষয়ে এনসিপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াত, ভিন্ন জোট অথবা এককভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত শিগগির স্পষ্ট করতে হবে। অথবা এমন সিদ্ধান্তহীনতা চলতে থাকলে এনসিপি ভেঙে তিন ভাগ হওয়ার আশাঙ্কা রয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক জোটের বিষয়ে জানা যায়, এনসিপির সঙ্গে জোট গঠন সম্পূর্ণ হলে চারটি অথবা পাঁচটি দল একসঙ্গে নির্বাচনি প্রচারে নামবে। জোটের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে লাগাতার বৈঠকে জোটের নামকরণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আলোচনা ফলপূস হলে সাম্প্রতিক সময়ে জোটের নাম ঘোষণা আসতে পারে বলেও জানা গেছে। একই সঙ্গে, গত এক মাসে আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা দল এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকারসহ ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক এবং আলাপ-আলোচনা করেছে। কিন্তু রাজনীতির হিসাব-নিকাশ না মেলায় দলগুলোর মধ্যে চূড়ান্ত কোনো জোট হয়নি। এখন জোর গুঞ্জন, আলাদা রাজনীতি করে এনসিপি রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়, যার জন্য এবি পার্টিসহ তিন অথবা চার দলের সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দলটি।
রাজনৈতিক জোটের বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন জোট গঠন হতে পারে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দল হিসেবে যারা সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে, তাদের নিয়ে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জোটে এবি পার্টির সঙ্গে এনসিপিসহ কয়েকটি দল থাকবে। আজকালের মধ্যেই জোট ঘোষণা হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জোটের বিষয়ে চারটি দলের (এনসিপি, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও আপ বাংলাদেশ) বাইরে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। শিগগির বিস্তারিত জানানো হবে।’
তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গঠনের সত্যতা নিশ্চিত করে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জন-আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ঐক্যের বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে পাঁচ-ছয়টি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি দল ও সংগঠন একমত হয়েছে। অন্যদের সঙ্গে আলাপ চলছে। তবে এখনই সবকিছু বলতে পারছি না।’
জোটের বিষয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচন ঘিরে বিএনপিসহ অনেক দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে কোন দলের অবস্থান বেশি মিলবে, তাদের সঙ্গেই জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মূল চাওয়া- গণতান্ত্রিক আচরণ, স্বচ্ছতা ও সংস্কারের বিষয়ে অঙ্গীকার। তবে এখনই জোট হচ্ছে না, ফলে নতুন মেরূকরণ হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারছি না। আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক লিয়াজোঁ প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আলোচনা বেশ আগে থেকেই চলছিল। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চলার সময় বিএনপির বাইরে এনসিপি, এবি পার্টি ও গণতন্ত্র মঞ্চের কিছু দল নিয়ে রাজনৈতিক একটি আলাপ-আলোচনা চলছিল। সেখান থেকেই বিএনপি-জামায়াতের বাইরে, সংস্কার ও জুলাই সনদের বিষয়ে ইতিবাচক দলগুলোকে নিয়েই মূলত একটি রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির হওয়ার চেষ্টা ছিল। এ ক্ষেত্রে এনসিপি, এবি পার্টি ও গণতন্ত্র মঞ্চের দু-একটি দলের পাশাপাশি আরও দু-একটি দল যুক্ত হতে পারে। তবে এটি এখনো পরিণতির দিকে আগায়নি। পরিণতি হলে তখন পূর্ণাঙ্গভাবে ঘোষণা দেওয়া হবে। আশা করি শিগগির এটি আত্মপ্রকাশের দিকে যাবে।’
তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের বিষয়ে আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে আমরা তৃতীয় একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছি। এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও আমরা এ উদ্যোগের কাছাকাছি এসেছি। এনসিপি, গণঅধিকারসহ সবাইকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য আলাপ-আলোচনা চলছে। বিএনপি, জামায়াত ছাড়া সবার সঙ্গেই আমরা এ আলোচনায় যাব। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও আমরা রাজনীতির মাঠে ভূমিকা রাখব।’
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনার একটি আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী এনসিপি নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জোট হবে কি হবে না- এমন দোলাচলে আমরা রাজনৈতিক মাঠে পিছিয়ে আছি। দল থেকেও প্রচারের জন্য সঠিক কোনো গ্রিন সিগন্যাল পাচ্ছি না। কারণ, শেষ পর্যন্ত যদি জোট হয় বা আসন সমঝোতা হয়, তাহলে অন্য আসন থেকেও নির্বাচন করতে হতে পারে। কিন্তু বড় দুই দল বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনি প্রস্তুতিতে অনেক এগিয়ে গেছে। একই সঙ্গে গণঅধিকার, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন সময় বিষয়গুলো এখনো পরিষ্কার না হওয়ায় সর্মথকদের পাশাপশি নেতারাও রয়েছেন কিছুটা দোটানায়।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুব এনসিপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, ‘কোন দলের সঙ্গে জোট হবে, তা আসন ছাড়ের প্রস্তুতির ওপর অনেকটা নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত এনসিপিকে প্রায় ৫০টি এবং বিএনপি প্রায় ২০টি আসন দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে তথ্য জানা গেছে। তবে, বিএনপির সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমাদের ভিন্নমত রয়েছে। আবার জামায়াতের সঙ্গেও জোটের সম্ভাবনা কম। কিন্তু এরকম সিদ্ধান্তহীনতা চলতে থাকলে এনসিপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা তিন ভাগে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এক অংশ বিএনপির দিকে, আরক অংশ জামায়াতের দিকে এবং বাকিরা স্বাধীনভাবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে পারে।’
এদিকে জানা গেছে, দুই ছাত্র উপদেষ্টা চান এনসিপি আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকুক। তবে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ অধিকাংশ নেতা এর জন্য অন্তত ২০টি আসন, নির্বাচনের মাঠে সাংগঠনিক সহায়তা এবং দলের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকার নিশ্চয়তা চান। এই নিশ্চয়তা না পেলে বিএনপির সঙ্গে জোট করতে রাজি নন অনেকেই। বিকল্প হিসেবে তারা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি-বিরোধী বৃহত্তর নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়েও ভেবেছেন। নতুনভাবে ভাবনার স্থান তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি। ফলে দোটানায় পড়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রনেতাদের গঠিত এনসিপি।
উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে রাজনীতিতে নতুন বলয় গঠনের আওয়াজ ওঠে। সে সময় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও নির্বাচনি ঐক্য : ক্ষমতা না জনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা হয়। যা আপ বাংলাদেশ, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন যৌথভাবে আয়োজন করে। পরের মাসে গত ৩ নভেম্বর আরও একটি আলোচনা সভা আয়োজন করে তারা, যে কর্মসূচিগুলোয় তৃতীয় রাজনৈতিক বলয় গড়ে ওঠার ব্যাপারে সমমনা দলগুলোর কাছাকাছি আসার একটি বার্তা ছিল। তাদের ঐক্যের ভিত্তি ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন, যার ধারাবাহিকতায় গত ৫ নভেম্বর রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সভা করে গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি ও গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল। সভায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন; জুলাই সনদের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নকেও প্রধান লক্ষ্য হিসেবে আলোচনা করা হয়।
দলগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে। যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কেউই বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোটে যায়নি, তাই তৃতীয় শক্তি বা নতুন জোট হওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়েই এসব কর্মসূচি ও আলোচনা চালিয়ে যায় তারা।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন