লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের চান্দার খালে সারিবদ্ধ ভাসমান নৌকার দৃশ্য যেন এক নির্মম বাস্তবতা। প্রায় ৬০টি জেলে পরিবার বছরের পর বছর ধরে নৌকাতেই ঘর বেঁধে দিন কাটাচ্ছে। সরু নৌকার ভেতরেই রান্না, ঘুম, শিশুদের কান্না- সব। জীবন যেন নদীর স্রোতের মতোই ভাসমান, অনিশ্চিত, প্রতিনিয়ত ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে বদলায় তাদের ভাগ্যও। কখনো মাছ পেলে দু’বেলা খাবার জোটে, কখনো খালি হাতে ফিরতে হয়। নদীভাঙন, দুর্যোগ, দারিদ্র্য আর দীর্ঘ অবহেলা-এসবই তাদের নিত্যসঙ্গী। সাত বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে জেলে নারী সালেহা বেগম বলেন, ‘সকালে পান্তা খাইছি। রাতে আল্লাহ যদি খাওয়ায় তবেই খাবো। স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই মাছ ধরি, কিন্তু অনেকদিন মাছ পাই না। কবর দেওয়ার মতো জায়গাও নাই আমাদের।’ তার কথায় ফুটে ওঠে চান্দার খালের মানুষের দীর্ঘ দুঃখগাথা। গরমে দমবন্ধ অবস্থা, বৃষ্টিতে পানি ঢোকে, শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা- প্রতিটি ঋতুই তাদের জন্য নতুন দুর্ভোগ। তবু ঘর না থাকায় নৌকাই তাদের স্থায়ী আশ্রয়।
বয়স্ক জেলে আলম মাঝির ভাষায়, ‘এই নদী আবার মা, আবার শত্রু। মাছ দেয়, আবার ঘরও নিয়ে যায়। তবুও নৌকা ছাড়া আর কিছু নাই।’ নৌকায় শিশুদের পড়াশোনা প্রায় অসম্ভব। স্কুলে ভর্তি হলেও যাতায়াতের ঝুঁকির কারণে অধিকাংশ শিশু স্কুলমুখী হয় না। সাধারণ জ্বর-সর্দি বা ডায়রিয়াও এখানে বড় বিপদ। জেলে ছগীর হোসেন জানান, ‘নদীতেই বাচ্চারা জন্ম নেয়, নদীতেই বড় হয়। সারা বছরই সংগ্রাম, বর্ষায় কষ্টটা আরও বাড়ে।’ ৬৫ বছর ধরে নদীতে বসবাসকারী প্রবীণ জেলে আলাউদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘কেউ খোঁজ নেয় না। বৃষ্টিতে ভিজি, রোদে শুকাই-আমরা কি মানুষ না?’
স্থানীয় যুবক শামিম বলেন, ‘প্রজন্ম ধরে তারা অধিকারবঞ্চিত। বাসস্থান, শিক্ষা, খাদ্য সবই সংকটে।’ চান্দার খালের এই ৫০-৬০ ভাসমান পরিবারের আর্তনাদ আজ প্রশাসনের কাছে স্থায়ী সমাধানের দাবি তুলছে তারা শুধু সহানুভূতি নয়, চায় নিশ্চিত জীবনমান, নিরাপদ আশ্রয় ও মৌলিক অধিকার।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাশেদ হাসান বলেন, ‘কার্ডবঞ্চিত প্রকৃত জেলেদের তালিকা করা হচ্ছে। জেলে কার্ড পেলে তারা সরকারি সহায়তা, ভিজিডি চাল, প্রশিক্ষণ ও উপকরণ পাবেন। নদীভাঙন ও বাসস্থানের বিষয়টি দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহেদী হাসান কাউছার জানান, ‘নৌকায় বসবাসকারীদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আনার কাজ চলছে। শিশুদের শিক্ষার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব দপ্তরকে নিয়ে আমরা স্থায়ী সমাধানের দিকে কাজ করছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন