আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম। উপদেষ্টা পরিষদে থাকা এই দুই ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্যই পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। তবে তারা কোন আসন কিংবা কোন দলের হয়ে নির্বাচন করবেন তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। দুই উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, বিএনপি, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কোনোটিই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদিও বর্তমানে বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদে যোগদান তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষমেশ এনসিপিতেই ঠাঁই হতে পারে তাদের।
জুলাই গণঅভ্যুত্থনে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক এই দুই উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, মাহফজুল আলম তার জন্মস্থান লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঢাকা-১০ (ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-কলাবাগান-হাজারীবাগ) আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী। কিছুদিন আগে আসিফ ধানমন্ডি এলাকার ভোটার হয়েছেন। এই আসনে তার মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। তবে মাহফুজ কোন এলাকা থেকে নির্বাচন করবেন তা পরিস্কার না করলেও আসিফ মাহমুদ ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। আসিফের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। এই উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-৩ আসন। তবে তিনি এই আসন থেকে নির্বাচন করবেন না বলে আগেই জানিয়েছিলেন।
এই দুই নেতার নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করার পর থেকেই তারা কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন তা নিয়ে আগ্রহ দেখা দেয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার না করায় দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তিও। যদিও দুজনই জানিয়েছেন, শিগগিরই তারা বিষয়টি পরিষ্কার করবেন।
জুলাই আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গড়া রাজনৈতিক দল এনসিপি গঠনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এই দুই নেতা। দলটি কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব কাজেই তাদের পরোক্ষ সমর্থন, পরামর্শ ও সহযোগিতা ছিল। সবার ধারনা ছিল সরকার থেকে পদত্যাগ করে তারা এনসিপিতে যোগ দিয়ে রাজনীতি করবেন।
এদিকে এনসিপির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি ও এনসিপি জনগণের মধ্যে আশানুরূপ সাড়া ফেলতে পারেনি। এরপর দুই ছাত্রনেতা বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির প্রার্থী হচ্ছেন বলে গুঞ্জন উঠেছিল। বিএনপির প্রথম ধাপের প্রার্থী তালিকায় লক্ষ্মীপুর-১ ও ঢাকা-১০ আসনে কোনো প্রার্থী ঘোষণা না দেওয়ায় গুঞ্জন ডালপালা মেলে। তবে তা বেশিদিন টিকেনি। সম্প্রতি এই দুই আসনে দলটি তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ঢাকা-১০ আসনে বিএনপির প্রার্থী শেখ রবিউল আলম ও লক্ষীপুর-১ আসনে বিএলডিপি বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেওয়া শাহাদাত হোসেন সেলিমকে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে বিএনপিতে তাদের যোগ দেওয়ার সম্ভবনা দেখছেন না রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে দীর্ঘদিন গণঅধিকার পরিষদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আসিফ মাহমুদ। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতিও। গণঅধিকারে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিও আছে আলোচনায়। তবে গণঅধিকার পরিষদের বড় একটি অংশ আসিফকে তাদের দলে ভিড়াতে চাচ্ছেন না। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, আসিফ মাহমুদকে নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তিনি উপদেষ্টা পরিষদে থাকাকালে নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাকে দলে নিয়ে অপকর্মের ভাগিদার হতে চাই না। বরং আমরা তার অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার (আজ) সংবাদ সম্মেলন করব।
দলটির উচ্চতর পরিষদ সদস্য আবু হানিফ বলেন, ‘আসিফ মাহমুদের গণঅধিকার পরিষদে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ দলের বড় অংশই তাকে চাচ্ছে না।’
যদিও শেষমেশ কোনো দলে যদি যোগদান করতে হয়, তবে সেটা এনসিপিতেই হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এরইমধ্যে এনসিপির অভ্যন্তরীণ পর্যায়েও এ নিয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। এনসিপির সঙ্গে তাদের কিছু টানাপোড়েনও রয়েছে।
এনসিপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বাসায় আসিফ মাহমুদসহ এনসিপির শীর্ষ নেতারা একটি বৈঠকে অংশ নেন। সেখানে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন, আগামী নির্বাচন, পদত্যাগ, দলে যুক্ত হলে পদ-পদবি কী হবে এসবসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। সূত্রটি জানায়, আসিফ ও মাহফুজ দুজনই দলের শীর্ষস্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ চান। এনসিপির পক্ষ থেকেও সেই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য সম্মানজনক কোনো পদ সৃষ্টি করা হতে পারে- এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। আবার তার এক ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কি না তানিয়ে মাহফুজ আলম দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা করে এসে আরও কয়েক বছর পর রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ারও ইচ্ছা আছে তার।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, তিনি কোনো দলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করেননি। এনসিপির সঙ্গে আলোচনা আছে আবার কিছু বিষয়ে দূরত্বও আছে। সম্প্রতি আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এনসিপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচন ও দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে মুখ্য সমন্বয়কের এ পদটিতে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। আসিফের এই আগ্রহে দলের একাংশের আগ্রহ থাকায় পদত্যাগ করে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। যদিও তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। তিনি ফের পুরোমমে কাজ করছেন দলটির জন্য।
তার ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও বলছে, এনসিপি, বিএনপি, গণঅধিকারসহ একাধিক দলের যোগদান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এনসিপির নেতৃত্বস্থানীয় এক নেতা বলেন, আসিফ ও মাহফুজকে নিয়ে এনসিপিতে আলোচনা আছে। দু-এক দিন আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভাও হয়েছে। দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ এনসিপির শীর্ষ নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যমান কাঠামোতে তারা যুক্ত হতে চাচ্ছেন না। তাদের জন্য হয়তো সম্মানজনক পদ তৈরি করা হতে পারে। কিংবা আগামী কাউন্সিলের মাধ্যমেও তারা দলে যুক্ত হতে পারেন। নির্বাচন স্বতন্ত্র করতে চাইলেও এনসিপির পক্ষ থেকে সমর্থন থাকবে।
অন্যদিকে গতকাল বুধবার ১২৫ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে এনসিপি। তবে তারা লক্ষ্মীপুর-১ ও ঢাকা-১০ আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। যেহেতু এনসিপি প্রার্থী দেয়নি, তাই অনেকে দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলেয়ে বলছেন তারা দুইজনই এনসিপিতে যোগ দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা স্বতন্ত্র নির্বাচন করার। তারপর দেখা যাক।’
এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যদি কেউ এনসিপিতে যোগ দিতে চান তাদের স্বাগত জানাবে এনসিপি।
তপশিল ঘোষণার হলেই আসিফ ও মাহফুজের পদত্যাগ কার্যকর : নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণার সঙ্গে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম পদত্যাগ কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় যমুনায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, গতকাল বিকেল ৫ টায় যমুনায় পদত্যাগপত্র জমা দেন দুই উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তাদের পদত্যাগপত্র নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি যুব ও ক্রীড়া, সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আসিফ মাহমুদ। আর মাহফুজ আলম ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। তাদের পদত্যাগের গুঞ্জনের মধ্যেই গতকাল বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আসিফ মাহমুদ। সেখানে তিনি তার সময়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ের বিস্তারিত ফিরিস্তি তুলে ধরেন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন