১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন জামায়াতে ইসলামী ১১ দফাসহ নানা গণদাবির বিরোধিতা করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নামে সহযোগী বাহিনী গঠন করে। জামায়াত ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বেই এসব বাহিনী তৈরি হয়। সে সময় তারা সারাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ নানা ধরনের নৃশংসতা চালায়। এসব অপরাধের দালিলিক প্রমাণ আজও ইতিহাসের নথিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
তাই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলেই আলোচনার কেন্দ্রে ফিরে আসে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটির অবস্থান বিশেষত পাকিস্তানি সামরিক শাসনের প্রতি সমর্থন ও আল-বদর, আল-শামসের মতো বাহিনী গঠনে সহযোগিতা আজও দেশের বড় অংশের মানুষের কাছে জবাবহীন একটি প্রশ্ন। বছরের পর বছর ধরে দলটি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই ব্যাখ্যাগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি অনুপস্থিত ‘স্পষ্ট দায় স্বীকার’।
দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব মাঝে মাঝে ‘ক্ষমা চাইবার’ মতো কিছু বক্তব্য দেন। যেমন গোলাম আজম ১৯৯৪ সালে নাগরিকত্ব ফিরে পেয়ে বলেছিলেন, ‘ভুল তো সবারই হয়।’ কিন্তু সেখানে ১৯৭১ বা যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ ছিল না। বর্তমান আমির শফিকুর রহমানও একই ধাঁচের সাধারণীকৃত ভাষায় বলেন, ‘একাত্তরে এদেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রত্যাশাকে তখনকার জামায়াত নেতৃত্বের ‘সম্মান করা উচিত’ ছিল। তবে তারা কেন করেননি, তা নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি নন, কেননা তিনি তখন ছিলেন না।
কথা বলার ফাঁকে শফিকুর রহমানকে হাতজোড় করতেও দেখা যায়। তার আগে-পরে তার মুখে ছিল হাসি। তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ মাত্রই ভুল করে।’ কিন্তু এই ‘ভুল’ কোন ভুল? সাংগঠনিক ত্রুটি? নাকি ১৯৭১-এর নৃশংস ভুল? কেউই স্পষ্ট করে না বলায় প্রশ্ন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
জামায়াতের ভেতর থেকেও কেউ কেউ বলেন, আমিরের বক্তব্য দলীয় অবস্থান নয়। আবার অদ্ভুতভাবে তারাই বলেন, ‘আমরা তার সঙ্গে দ্বিমত করি না।’ এই দ্বৈত অবস্থান আসলে দলের গভীর অস্বস্তিকেই প্রকাশ করে। কারণ ১৯৭১-এর দায় স্বীকার মানে শুধু নৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও বিশাল চাপের মুখে পড়া। একটি দলের জন্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পরে সেই দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা ইতিহাসে এমন নজির কোথাও নেই। সুতরাং স্বীকারোক্তি মানে তাদের জন্য শুধু ক্ষমা চাওয়া নয়, পরিচয়গত সংকটেও পড়ে যাওয়া।
জামায়াত যে ক্ষমা চাইতে চায়, কিন্তু দায় স্বীকার করতে চায় না এটা অনেকদিনের একটি ধারা। দলের ভেতরে প্রচলিত আছে যে মতিউর রহমান নিজামী নাকি কখনো ক্ষমা চেয়েছিলেন। কিন্তু নথিপত্রে দেখা যায় তিনি ১৯৭১-এর ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক অভিযোগ’ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন। তার সেই বিতর্কিত উক্তি, ‘জামায়াতে ইসলামী লুটপাট বা ধর্ষণের প্রশ্নই আসে না’, আসলে দায়বদ্ধতার পরিবর্তে ইতিহাসকে অস্বীকারেরই প্রচেষ্টা।
গত কয়েক দশকে দলটি একটি নতুন ন্যারেটিভ গড়ে তুলেছে : ‘ভুল হয়েছে’, ‘কেউ আঘাত পেলে আমরা দুঃখিত’ ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন ভুল? কাদের প্রতি দুঃখ? কেন এই ভুল ঘটেছিল? কিছুই নির্দিষ্ট নয়। এই অস্পষ্ট ক্ষমা আসলে রাজনৈতিক চাপের মুখে তৈরি এক ধরনের কৌশলী অবস্থান। আন্তরিক বা নৈতিক সিদ্ধান্ত নয়। দলটির উদ্দেশ্য ইতিহাসের সেই অস্বস্তিকর অধ্যায় পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলা। কিন্তু জাতির জন্মের কেন্দ্রীয় ঘটনার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয়।
জামায়াতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট এখানেই। স্বীকারোক্তি দিলে তাদের সমর্থকদের একটা বড় অংশ ভেঙে যেতে পারে। দলীয় পরিচয় সংকটে পড়তে পারে। এমনকি বর্তমান নামেও রাজনীতি চালানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তাই ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে তারা বারবার পিছিয়ে যায়।
তবুও প্রশ্ন ওঠে, রাজনৈতিকভাবে কি স্বীকারোক্তি তাদের জন্য দরকার ছিল না?
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী হঠাৎ করেই এক ধরনের নতুন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি সমাজের একাংশ স্বীকারও করেছিল। অনেকের চোখে তারা ছিল ‘অত্যাচারের শিকার’, যেমন আবু সাঈদ, আবরার ফাহাদের ঘটনার পর সৃষ্ট সহানুভূতি। এই ছিল তাদের বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে অনুকূল রাজনৈতিক মুহূর্ত। যদি তারা তখন নির্ভীকভাবে ১৯৭১-এর ভূমিকার একটি স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিত, তাহলে হয়তো রাজনৈতিক পুনর্বাসনের পথ আরও মসৃণ হতে পারত।
কিন্তু তারা সেটা করল না। কারণ আরেকটি বাস্তব প্রশ্ন আছে, সমাজ কি তাদের ক্ষমা করতে প্রস্তুত? ৩০ লাখ শহিদ, দুই লাখ ধর্ষিতা নারী, যুদ্ধাপরাধের নথিভুক্ত অভিযোগ, এত বড় ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে ‘ক্ষমা করে দাও’ বলা কি এত সহজ? এক ধরনের নৈতিক ডেডলক তৈরি হয়েছে। জামায়াত এগোতে পারছে না; সমাজও ক্ষমা করতে পারছে না।
তা ছাড়া, যুদ্ধাপরাধের বিচার একসময় জামায়াতকে রাজনৈতিক সংকটে ফেললেও, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে যখন বিচারকে প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে দেখা হলো, জামায়াত নতুনভাবে লাভবানই হলো। তারা বলতে পারল, ‘এ বিচার রাজনৈতিক।’ কিন্তু বিচার নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও ইতিহাস পাল্টায়নি। ১৯৭১-এর নথিভুক্ত তথ্য, সাক্ষ্য, দলিল আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
এ কারণেই জামায়াতের আজকের রাজনৈতিক সংকট এত দীর্ঘস্থায়ী। ক্ষমা চাওয়ার ভাষা রয়েছে, কিন্তু দায় স্বীকারের সাহস নেই। তারা ‘ফরওয়ার্ড লুকিং’ হতে চায়, কিন্তু অতীতকে মিটিয়ে না দিলে ভবিষ্যৎ কখনোই মসৃণ হবে না। ১৯৭১ কোনো পারিবারিক ঝগড়া নয় যে একটি ‘দুঃখিত বলেই সব মিটে যাবে। এটি একটি জাতির জন্মের রক্তাক্ত ইতিহাস এখানে দায়, অপরাধ, এবং সত্যের স্বীকারোক্তি ছাড়া ক্ষমা চাওয়া অর্থহীন।
জামায়াতে ইসলামী এখনো ১৯৭১-এর প্রতি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। ক্ষমার একটি ন্যারেটিভ তৈরি করেছে, কিন্তু দায় স্বীকারের রাজনীতি তৈরি করতে পারেনি। তাই তাদের বক্তব্য সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ‘একাত্তর নিয়ে বিতর্ক’ মীমাংসাহীনই থেকে যায়।
প্রশ্ন এখন একটাই, জামায়াত কি ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস দেখাবে? নাকি অস্পষ্ট ক্ষমা ও ন্যারেটিভের আড়ালে একই সংকট নিয়ে আরও দীর্ঘ পথ হাঁটবে?

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন