যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ইরান, পারমাণবিক কর্মসূচি চলবে
সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইরান ১ হাজার ৬২ জন মানুষকে হারিয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছে দেশটির সরকার। গত মঙ্গলবার সাপ্তাহিক এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইরানের সরকারি মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজারানি জানান, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৮৬ জন ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং ২৭৬ জন ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ জন্য প্রয়োজনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তারা প্রস্তুত।
এ ছাড়া চলমান যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইরান তেমন আশাবাদী নয় বলেও জানিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন পেজেশকিয়ান। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা দেশ ও ইসরায়েলের উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই এ সাক্ষাৎকার দেন। এটি ছিল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর তার প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাৎকার।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের একাধিক পরমাণু স্থাপনা ও বেসামরিক স্থানে হামলা চালায়। পালটা হামলায় নামে ইরান। পরে যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলায় যোগ দেয়। ইরানও মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোয় তেমন ক্ষতি হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো এখন ইরানের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার কথা বলছে। তারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির স্থায়ী সমাধান চায় এবং নিশ্চিত করতে চায়, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে না। অন্যদিকে ইসরায়েলি নেতারা বলছেন, ইরানকে তার পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যেতে দেওয়া হবে না এবং নতুন যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সম্প্রতি বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে ফের যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে। এর জবাবে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ইরান আন্তর্জাতিক আইন মেনে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। যারা মনে করছে আমাদের কর্মসূচি শেষ হয়ে গেছে, তারা ভুল করছে। আমাদের সক্ষমতা শুধু স্থাপনায় নয়, বিজ্ঞানীদের মেধায় নিহিত। তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের কোনো নতুন হামলার জন্য আমরা প্রস্তুত।
আমাদের বাহিনী ইসরায়েলের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম। যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইরান তেমন আশাবাদী নয় বলে জানান পেজেশকিয়ান।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে বেশি আশা করছি না। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত।’ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে, আমরাও তাদের ক্ষতি করেছি।
তারা আমাদের ওপর শক্তিশালী হামলা চালিয়েছে, আমরাও তাদের গভীরে আঘাত হেনেছি। কিন্তু তারা তাদের ক্ষতি গোপন রাখছে। ২৪ জুন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ৯০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক। অন্যদিকে ইরানের হামলায় ইসরাযেলে ২৮ জন নিহত হয়।’ পেজেশকিয়ান বলেন, ‘আমরা পরমাণু অস্ত্র চাই না। এটি আমাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থান।’ তিনি জানান, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোয় কঠোর পরিদর্শনের পরেও শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রমাণই পেয়েছে। নতুন করে আলোচনার সম্ভাবনার ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘যেকোনো আলোচনা হতে হবে সমতার ভিত্তিতে এবং আমাদের শান্তিপূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার অক্ষুণ্ন রেখে।’
ইরানের সরকারি মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজারানি জানান, ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইরান ১ হাজার ৬২ জন মানুষকে হারিয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০২ জন নারী ও ৩৮ জন শিশু রয়েছে। এ ছাড়া পাঁচজন প্যারামেডিক, পাঁচজন নার্স ও সাতজন জরুরি সেবাকর্মীও নিহত হয়েছেন। বেসামরিক হতাহতের মধ্যে ৩৪ জন শিক্ষার্থী ছিলেন ও পাঁচজন শিক্ষক। মোহাজারানি বলেন, ‘একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও একাডেমিক কর্মীও নিহত হয়েছেন। তবে তাদের সঠিক সংখ্যা আমরা জানাইনি।’ দেশটির রাজধানী তেহরান প্রদেশেই সবচেয়ে বেশি ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সরকারি তথ্যমতে, যুদ্ধের ফলে বেসামরিক অবকাঠামোতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৬টি প্রদেশে ৩৬টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ২১৯টি শিল্প ইউনিট, যার মধ্যে রয়েছে বড় কারখানা থেকে শুরু করে ছোট ছোট উৎপাদনকেন্দ্রও। ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষ হওয়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইরান মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে নতুন করে রাজনৈতিক বার্তা দিল। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ‘কাসেদ’ নামের উৎক্ষেপণযান ব্যবহার করে সাবঅরবিটাল কক্ষপথে সফলভাবে একটি স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধুই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং একটি কৌশলগত মনোভাবের প্রকাশ।ওয়াশিংটনের এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সহকারী অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক সিনা আজোদি মনে করেন, ইরান এখন কেবল সক্ষমতা বাড়ানোর পথেই নেই, বরং একইসঙ্গে স্পষ্টভাবে শক্তির বার্তা দিচ্ছে। তিনি বলেন, এমন উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করছেÍযা সরাসরি সংঘাত ছাড়াই অর্জন সম্ভব হচ্ছে।ইরান দাবি করছে, তাদের মহাকাশ গবেষণার অংশ হিসেবেই এই উৎক্ষেপণ। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি প্রকৃতপক্ষে সামরিক কৌশলেরই অঙ্গ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু ফক্স জানান, ইরান এই উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, দীর্ঘমেয়াদি সামরিক পরিকল্পনা এখনও বহাল রয়েছে। এমনকি বিকল্প পথে তারা শক্তি ধরে রাখার চেষ্টায় রয়েছে।ওয়াশিংটনের গবেষক ফাতিমা আল-আসরা মনে করেন, একই প্রযুক্তিতে স্যাটেলাইট ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন :