মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর এক ‘হুমকি’। এর মধ্যে ছিল অব্যাহত চাপ। তা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করেনি ভারত। আর তাতেই নয়াদিল্লির ওপর বেজায় চটেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এবার তিনি ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে কঠিন কূটনৈতিক সমীকরণ সামলাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একদিকে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন, অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মোদি ভারতকে নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেনÑ যা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে একরকম অস্বস্তিকর। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার জন্য বুধবার ভারতীয় পণ্যে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। বাড়তি ২৫ শতাংশের ফলে আগামী ২৭ আগস্ট থেকে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হলে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।
ভারতের পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক আরও বাড়ানোর পর বেশ কড়া বার্তা দিলেন নরেন্দ্র মোদি। কৃষক ও জেলেদের স্বার্থে ভারত কারো সঙ্গে আপস করবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। এ জন্য যে তাকে মূল্য দিতে হবে, সেটিও স্বীকার করেছেন। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শুল্ক যুদ্ধ প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য করেন মোদি। এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোদি বলেছেন, দেশের কৃষকদের জন্য তিনি চড়া মূল্য দিতেও প্রস্তুত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষকের স্বার্থই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভারত কখনোই তার কৃষক, খামারি ও জেলেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে আপস করবে না। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে, আর এই খাতই ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের বাজারে তাদের কৃষকদের তৈরি পণ্য রপ্তাতি করতে চায়। তবে মার্কিন পণ্য ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের উল্লেখযোগ্য হারে শুল্ক গুনতে হয়।
এনডিটিভি বলছে, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পেছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট আছে। ওয়াশিংটন চাচ্ছিল ভারতের কৃষি বাজারে আরও প্রবেশাধিকার, কিন্তু নয়াদিল্লি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এই পরিস্থিতিতে মোদির ‘কৃষকের স্বার্থে আপসহীনতা’র বার্তা স্পষ্টভাবে শুল্ক চাপের জবাব হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন শিগগিরই ভারত সফরে আসছেন। বৃহস্পতিবার ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এ কথা জানিয়েছেন। মস্কোতে থাকা দোভাল জানান, সফরের তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে ইন্টারফ্যাক্স সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, এটি আগস্টের শেষের দিকে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার মধ্যে এই সফর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে আমদানি করা মার্কিন পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আগ্রাসনের জবাব দেওয়া উচিত। কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা শশী থারুর এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন। সংসদ ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের শশী থারুর বলেন, ‘প্রথমে আমাদের আলোচনায় বসা উচিত। জানি না, ট্রাম্প আমাদের ওপর এত রেগে আছেন কেন।
চীনকে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল, আর আমাদের মাত্র ২১ দিন। এখন যদি তারা শুল্ক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, তবে আমাদের জবাবও হতে হবে পাল্টা শুল্ক।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের পক্ষে রাশিয়া থেকে তেল কেনা একটি পরিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ, রাশিয়ান তেল ভারতে আসে বড় ছাড়ে, যা ঐতিহ্যবাহী তেল সরবরাহকারী দেশগুলো দেয় না। ভারতের ১.৪ বিলিয়নের বেশি জনসংখ্যা ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি রাশিয়ান তেলের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। দেশটি বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেলভোক্তা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে রয়টার্স। রাশিয়া থেকে আসা অপরিশোধিত তেল বর্তমানে ভারতের মোট তেল আমদানির ৩৬ শতাংশ, যা দেশটির সর্ববৃহৎ তেল সরবরাহকারী হিসেবে রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়।
এর পর থেকেই সেই তেল এশিয়ার দিকে চলে আসে বিশেষত চীন, ভারত ও তুরস্কে। ভারত সেই তেল ছাড়ে পাচ্ছে, যা অন্য দেশগুলো দিচ্ছে না। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিতাভ সিংহ বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণভাবে একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। ভারতের পক্ষে এটি শুধু লাভের বিষয়, কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নয়।’ ভারত তার তেলের উৎস বৈচিত্র্যময় করেছে ঠিকই, কিন্তু রাশিয়ান তেল হঠাৎ পুরোপুরি বন্ধ করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, দেশটির ৮০ শতাংশ তেলের চাহিদা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির কড়া বিরোধিতা করেছে রাশিয়া। সেই সঙ্গে ভারতের পাশে থাকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে দেশটি। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সার্বভৌম কোনো দেশের স্বাধীনভাবে বাণিজ্যসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া মস্কো অভিযোগ করেছে, ট্রাম্প বিভিন্ন দেশকে হুমকি দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করছেন। বৃহস্পতিবার ক্রেমলিনে রুশ প্রশাসনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, আমরা (ট্রাম্পের) অনেক বিবৃতির কথাই শুনছি, যেগুলো আসলে হুমকি।
আপনার মতামত লিখুন :