সাম্প্রতিক হঠাৎ ও তীব্র বৃষ্টিপাতের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিয়েছে। আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের ফলে পুরো জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জনবসতিগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যার কারণে গ্রামগুলো ভেসে গেছে। কমপক্ষে ৭০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বুনার অঞ্চলের দশটিরও বেশি গ্রাম আকস্মিক বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখনো অনেকে কাদা ও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের হিমালয়ের চাশোটি শহরে গত শুক্রবার (১৫ আগস্ট) কাদা ও পানির ঢলের কারণে কমপক্ষে ৬০ জন নিহত এবং ২০০-এরও বেশি নিখোঁজ হয়। চলতি মাসের শুরুতে ভারতের উত্তরাখ- রাজ্যের পাহাড়ি একটি গ্রামে বন্যা আঘাত হানে, এতে কমপক্ষে চারজনের মৃত্যু হয়।
উভয় দেশের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাণঘাতী বন্যা ও ভূমিধসের বেশির ভাগ ঘটনা আকস্মিক ও মুষলধারে বৃষ্টিপাত বা মেঘ বিস্ফোরণের কারণে ঘটেছে। মেঘ বিস্ফোরণ হলো হঠাৎ করে একটি ছোট এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হওয়া। ফলে বিপজ্জনক আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের সূত্রপাত ঘটে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বাতাসে প্রচুর আর্দ্রতা থাকলে এটি সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে ঘটে। মৌসুমি বায়ু পর্বতগুলোয় আঘাত হানে। এরপর তা দ্রুত শীতল হয়ে ওপরের দিকে ওঠে এবং ঘন মেঘে ঘনীভূত হয়, যা পরে প্রবল বর্ষণ ঘটায়।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতি ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার (৪ ইঞ্চি) বেশি বৃষ্টিপাতকে মেঘ বিস্ফোরণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এ ধরনের বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, ‘ঝড়গুলো এত ছোট এবং দ্রুত যে সেগুলোর সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া যায় না।’ এই অঞ্চলের উচ্চ দারিদ্র্য, দুর্বল অবকাঠামো এবং মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়ে। ইসলামাবাদভিত্তিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আলী তৌকীর শেখ বলেন, ‘দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার অভাব সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাপক বন উজাড়ের কারণে মেঘ বিস্ফোরণ, ভূমিধস ও কাদা-ধস হয়ে থাকে।’
ক্ষয়ক্ষতির কারণ নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্রায়ই এসব এলাকায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে, কারণ মানুষের বড় অংশ জলাশয়ের পাশে বাস করে এবং প্রস্তুতির জন্য সময় খুব কম থাকে।’ কোল বলেন, ‘উষ্ণ সমুদ্র মৌসুমি বায়ুকে অতিরিক্ত আর্দ্রতা দিয়ে ভরে তুলছে। উষ্ণ বায়ুম-ল আরও বেশি পানি ধরে রাখে, যা খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে প্রবল বৃষ্টিপাত সৃষ্টি করে।’ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সময়, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু অংশে বার্ষিক বৃষ্টিপাত হয়। এটি ভারত মহাসাগর এবং আরব সাগর থেকে আসা বাতাসের মাধ্যমে আসে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। তৌকীর শেখ বলেন, ‘যদি দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়, তবে বৃষ্টিপাত আরও ভারী হবে।’ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ এক শতাংশেরও কম। তবুও গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুসারে, জলবায়ু সংকটের কারণে দেশটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২২ সালে পাকিস্তান সবচেয়ে ভয়াবহ বর্ষা মৌসুমের শিকার হয়।
বন্যায় প্রায় ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং আনুমানিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতের ব্যাপারে কোল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষার ধরন বদলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারতে অতিবৃষ্টির ঘটনা তিনগুণ বেড়েছে।’শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। আর এর ফলস্বরূপ এই বছরে পাকিস্তান, ভারত ও নেপাল বন্যার কারণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, শতাব্দীর শেষে বিশ্ব প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার দিকে এগোচ্ছে, যা সংকটকে আরও খারাপ করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন