মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের চাউং ইউ টাউনশিপে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের থাডিংজুত পূর্ণিমা উৎসব চলছিল। উৎসবের আয়োজক কমিটির এক সদস্য ও এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শতাধিক মানুষ উৎসবে ও জান্তাবিরোধী প্রতিবাদে অংশ নিতে জড়ো হয়েছিলেন। তখন হঠাৎ আকাশ থেকে সামরিক বাহিনী বোমা ফেললে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও জানিয়েছে, এ হামলায় অন্তত ৪০ জন প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। জান্তা সরকার এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মন্তব্য করেনি। সেনা সরকার ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ থেকে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে, তবে জাতিসংঘের এক বিশেষজ্ঞ এটিকে ‘প্রহসন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বিদ্রোহীরা ঘোষণা দিয়েছে, তারা এ নির্বাচন ঠেকাবে।
বর্তমানে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের ঘাঁটি অবরুদ্ধ করে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা পুনর্দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আয়োজক কমিটির এক নারী সদস্য বলেন, ‘আমরা মানুষকে সতর্ক করেছিলাম, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল। কিন্তু হঠাৎ একটি মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার ভিড়ের ওপর দিয়ে উড়ে এসে দুটি বোমা ফেলে।’ ওই নারী বলেন, ‘একটি মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার সরাসরি ভিড়ের ওপর উড়ে গিয়ে দুটি বোমা ফেলে। শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আজ সকাল পর্যন্তও আমরা মাটি থেকে শরীরের টুকরো, মাংসপি- ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘শিশুরা সম্পূর্ণভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন আমরা যখন শেষকৃত্যে অংশ নিই, তখনো মাটিতে ছড়িয়ে থাকা শরীরের টুকরো, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও ছিন্ন দেহাংশ সংগ্রহ করা হচ্ছিল।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘যখন আকাশে প্যারামোটর উড়তে দেখি, তখন মানুষ দৌড়াতে শুরু করে। আমি বলছিলাম ‘দৌড়াবেন না’, ঠিক তখনই দুটি বোমা ফেলা হয়।’ তিনি জানান, ‘আমার সামনে দুই সহযোদ্ধা মারা যায়, আরও অনেকে প্রাণ হারান।’ পরদিন তিনি নিহত ৯ বন্ধুর জানাজায় অংশ নিয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে এ হামলাকে ‘নৃশংস ও জঘন্য’ বলে বর্ণনা করে জানিয়েছে, এটি প্রমাণ করে মিয়ানমারের বেসামরিক জনগণ এখনো গুরুতর বিপদের মুখে রয়েছে। সংস্থাটির মিয়ানমারবিষয়ক গবেষক জো ফ্রিম্যান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো মিয়ানমারের সংঘাত ভুলে গেছে, কিন্তু সেনাবাহিনী এ নজরদারির অভাবের সুযোগ নিয়ে নির্বিচারে যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জোট আসিয়ানকে আহ্বান জানান, আসন্ন বৈঠকের আগে যেন তারা মিয়ানমার জান্তার ওপর চাপ বৃদ্ধি করে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। গণতন্ত্রপন্থি বিদ্রোহীরা ও বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী একজোট হয়ে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে। এদিকে সেনা সরকার আগামী ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে, যেটিকে জাতিসংঘের এক বিশেষজ্ঞ ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, তারা এ তথাকথিত নির্বাচন ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী বিভিন্ন বিদ্রোহী ঘাঁটিকে অবরুদ্ধ করে নিজের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলের চাউং উ টাউনশিপে শত শত মানুষ থাদিংগ্যুত পূর্ণিমা উৎসব ও এক বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছিলেন। এক প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় আয়োজক কমিটির সদস্য মঙ্গলবার এএফপিকে এ তথ্য জানিয়েছেন। দেশের অর্ধেকের বেশি অংশের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর সেনাবাহিনী এখন আবারও বিমান হামলা ও ভারী বোমাবর্ষণের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী অভিযান শুরু করেছে। এতে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছে। সোমবার হামলা চালানো শহরটি সাগাইং অঞ্চলে অবস্থিত। এটি জান্তা ও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘাতের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এর বড় অংশ জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনও পরিচালনা করছে।
স্থানীয় পিডিএফের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, সোমবারের সমাবেশে আকাশপথে সম্ভাব্য হামলার তথ্য তাঁরা আগে পেয়েছিলেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা দ্রুত প্রতিবাদ সমাবেশ শেষ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্যারামোটরগুলো প্রত্যাশার চেয়ে আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। পিডিএফের কর্মকর্তা আরও বলেন, পুরো ঘটনাটি সাত মিনিটের মধ্যে ঘটে গেছে। বিস্ফোরণে তিনি আহত হয়েছেন। তবে তাঁর কাছাকাছি থাকা কয়েকজন নিহত হয়েছেন।স্থানীয় লোকজন বিবিসিকে বলেন, ঘটনার পর নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ শনাক্ত করা কঠিন ছিল।