জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন তাদের একজন আলখেইর ইসমাইল। এই তরুণ, দারফুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসে বলেন, ‘রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর সময় আরএসএফ প্রায় ৩০০ জনকে আটক করে। আমি সেই দলের অংশ ছিলাম। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিচিত ব্যক্তির অনুরোধে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্য সবাইকে হত্যা করা হয়।’ অন্য একজন ২৬ বছর বয়সি নারী জানান, তার স্বামী সন্তানদের বাঁচাতে মুক্তিপণ দেন, কিন্তু পরে তার সামনেই তাকে হত্যা করা হয়। এক ১৯ বছর বয়সি তরুণী বলেন, ‘আমাকে ধর্ষণ করা হয়, তার আগে জানতে চাওয়া হয়েছিল আমি কুমারী কি না।’ অন্যদিকে, তাহানি হাসান নামের এক নারী বলেন, “হঠাৎ করেই তারা হাজির হয়। আরএসএফের পোশাকে তিন তরুণ এসে আকাশে গুলি ছুড়ে বলে ‘থামো’। এরপর তারা আমাদের বেধড়ক মারধর করে এবং পোশাক ছুড়ে ফেলে দেয়। আমি নারী হয়েও তল্লাশির শিকার হই।” ফাতিমা আবদুলরহিম, যিনি তার নাতি-নাতনিদের নিয়ে তাবিলায় পৌঁছেছেন, বলেন, “তারা ছেলেশিশুদের মারধর করে, সব সম্পদ লুটে নেয়। আমাদের কিছুই রাখেনি। শুনেছি, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে।” এক তরুণী রাওয়া আবদাল্লা জানান, তার বাবা এখনো নিখোঁজ। অনেকের মতোই তিনিও জানেন না, তার প্রিয়জনেরা বেঁচে আছেন কি না।
একজন বেঁচে থাকা ব্যক্তি বলেছেন, “আরএসএফের সেনারা বন্দিদের গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করেছিল।” এ ছাড়া, আরএসএফ শহরের চারপাশে এমনভাবে পরিখা খনন করেছে যাতে কেউ পালাতে না পারে। তাদের লক্ষ্য হলো শহরকে পরিকল্পিতভাবে অনাহারে রাখা। এককথায় এই সংঘাতে মানুষের জীবন একেবারেই মূল্যহীন। কেউ কেউ তাওইলা শহরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে লাখ লাখ মানুষ আশ্রয় খুঁজছেন। এল-ফাশার থেকে আসা মানুষগুলো এমন এক পরিস্থিতি থেকে আসছে, যাকে কেবল নারকীয় দৃশ্য হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া, শুধু আরএসএফই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে না। এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন অনুসারে, সুদানের সশস্ত্র বাহিনীও (এসএএফ) বেসামরিক জনগণের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ করেছে।
শত্রুর মনোবল ভেঙে ফেলতে অনেক ক্ষেত্রেই আরএসএফ কমান্ডাররা অতিরিক্ত মাদকাসক্ত সৈন্যদের দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শিশু সৈনিকও আছে। আর এর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে তারা নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও ধর্ষণ করছে। দারফুরের সংকট ব্যবস্থাপক, সাহায্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) আরজান হেহেনক্যাম্প এ রকমই কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
ইয়েমেন থেকে সুদান: ঘরে ঐক্যের কথা, বাইরে অশান্তি ছড়াচ্ছে আরব আমিরাত: দি ইকোনমিস্টের নিবন্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো সুদানি আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সমর্থন দিয়েছে।
আরব আমিরাত এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রিম কেতায়েত বলেছেন, এটি ‘নোংরা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা’। তাঁর দাবি, সুদানের সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই দুই বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লড়াইরত আরএসএফ।
বিষয়টি সত্যি যে, সুদানি সেনাবাহিনীও যুদ্ধাপরাধ করেছে। কিন্তু আরএসএফের প্রতি আমিরাতের সমর্থন নিয়ে কারও তেমন সন্দেহ নেই। তবে তারপরও আইনি জটিলতার কারণে মামলাটির সামনে এগোনোর সম্ভাবনা কম। তবে এই ঘটনা একটি প্রবণতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আমিরাত এমন সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা হয়Ñরাষ্ট্র দখল করতে চায়, নয়তো সেটিকে ভাঙতে চায়।
আধুনিক আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু এখন সৌদি আরব ও আমিরাত। দুই দেশই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও প্রভাবশালী কূটনৈতিক শক্তি। উভয়ই নিজেদের বহু মেরু বিশ্বের স্বাধীন শক্তি হিসেবে দেখে। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের পথ আলাদা। সৌদি আরব স্থিতিশীলতাকে মূল স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে এবং (যদিও সব সময় নয়) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, সাতটি আমিরাত নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (যার মধ্যে দুবাই আছে এবং সবচেয়ে ধনী আবুধাবি) নীতিনির্ধারণ ভিন্ন ধাঁচের। লিবিয়ায় তারা বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। হাফতারই লিবিয়ায় জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। ইয়েমেনে আমিরাত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে সমর্থন দিচ্ছে। সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চলÑপুন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ডের নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে দেশটি।
তবুও চালায় পাশবিকতা
সুদানের প্যারামিলিটারি আরএসএফের ভয়াবহতার চিত্র দিন দিন আরও ফুটে উঠছে। গত সপ্তাহে দেশটির দারফুর অঞ্চলের আল-ফাশার শহর দখলের সেখানে সব ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে তারা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে এক নারী জানিয়েছেন, যখন আরএসএফ তার শহরে আসে, তখন নিজের ছেলেদের খুঁজতে বের হন তিনি। তখন তাকে একটি রুমে নিয়ে যায় আরএসএফের ফাইটাররা। তার ওপর ওই সময় যৌন নিপীড়ন চালায় তারা। নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নিজেকে মায়ের বয়সি হিসেবে অভিহিত করেও রক্ষা পাননি তিনি। তার ওপর চালানো হয় পাশবিকতা। বর্তমানে সুদানের উত্তরাঞ্চলের আল দাব্বাহ একটি শরণার্থী ক্যাম্পে আছেন তিনি। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম গোপন রাখা এ নারী বলেন, ‘আরএসএফ যখন সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার দখল করে আমি মেয়েদের ঘরে রেখে ছেলেদের খুঁজতে বাইরে বের হই। আরএসএফ আমাকে আটকে জিজ্ঞেস করে আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি তাদের জানাই, আমার ছেলেদের খুঁজছি।
তারা আমাকে জোর করে একটি বাড়িতে নিয়ে সেখানে যৌন নিপীড়ন শুরু করে। আমি তাদের বলিÑ আমি তাদের মায়ের বয়সি। আমি শুধু কেঁদেছি।’ যে ছেলেদের খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাদের তিনি আর খুঁজে পাননি। ছেলেরা কোথায় আছে এখন পর্যন্ত তা জানেন না। ‘নিপীড়নের পর তারা আমাকে যেতে দেয়। আমি তখন মেয়েদের নিয়ে পালিয়ে যাই। ছেলেদের সেখানেই রেখে এসেছি। তারা এখন কোথায় আছে আমি তা জানি না।’ ‘আরএসএফের বাধা পার হওয়া পর্যন্ত আমরা শুধু মরদেহ দেখেছি। এরপর এল-ফাশারের বাইরের একটি ছোট গ্রামে গিয়ে পৌঁছাই’Ñ বলেন এ নারী। এল-ফাশারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার পাশাপাশি অনেক নারীকে তারা ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুদানে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। এই সংঘাতের পেছনে স্বাধীনতা অর্জন, বৈষম্য দূরীকরণ বা শোষকের হাত থেকে মুক্তিÑ এ ধরনের কোনো কারণ নেই। দুই জেনারেলের ব্যক্তিগত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকেই মূলত এই ‘নারকীয়’ পরিস্থিতির জন্ম। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বাধীন সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) বিরুদ্ধে লড়ছে তারই এককালের সহযোগী ও ‘বন্ধু’ মোহামেদ হামদান ‘হেমেতি’ দাগালো-এর আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা অন্তত দেড় লাখ। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, এই সংঘাতে দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি মানুষ। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ।
সুদানে প্যারামিলিটারি বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ শহর এল-ফাশের দখলের পর সুদানে রক্তপাত বন্ধের জন্য মুসলিমবিশ্বকে তাদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। তিনি সোমবার বলেন, ‘কারো হৃদয়ে সহমর্মিতা থাকলে... এল-ফাশেরে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে সাম্প্রতিক গণহত্যা মেনে নিতে পারে না।
সুদানের এল-ফাশের এবং সমগ্র দারফুর অঞ্চলে মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করায় মালয়েশিয়া অবিলম্বে সব সহিংসতা বন্ধের জরুরি আহ্বান জানিয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘গভীর উদ্বেগজনক এক মহাবিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সোমবার (৩ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার এই ট্র্যাজেডিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
        
                            
                                    
                                                                
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
                                    
                                    
                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                            
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন