আম্মার ওয়াদি। তার মোবাইলের স্ক্রিনে ‘মা, আমার কিছু হয়ে গেলে আমাকে ক্ষমা করো। যে আমার ফোনটি পাবেন, তিনি যেন আমার পরিবারকে বলে দেন, আমি তাদের খুব ভালোবাসি’Ñ লিখে রেখেছিলেন। ফিলিস্তিনের গাজায় গত জুনে জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে ত্রাণবাহী ট্রাক থেকে পরিবারের জন্য এক ব্যাগ আটা আনতে গিয়েছিলেন আম্মার ওয়াদি। তিনি জানতেন, এর মাধ্যমে তিনি নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। গ্রীষ্মের ওই সময় ত্রাণ আনতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিতভাবে গুলিবর্ষণ করত। এর মধ্যেই একদিন ত্রাণ আনতে যান ওয়াদি। কিন্তু এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। কয়েক সপ্তাহ পর এক ব্যক্তি ওয়াদির মোবাইল ফোন পেয়ে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে পাওয়া শেষ বার্তাটি পায় পরিবার। তখন অসংখ্য ফিলিস্তিনি জিকিমের কাছে নিখোঁজ হন। ওয়াদি ছিলেন তাদের একজন। এসব ফিলিস্তিনির ভাগ্যে কী জুটেছে, তা আজও অজানা। তবে ওই ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া গেছে সিএনএনের এক অনুসন্ধানে। তাতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনারা জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে কিছু ব্যক্তির মরদেহ বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দিয়েছেন। তাদের এভাবে কবর দেওয়ার চিহ্নও রাখা হয়নি। এ ছাড়া কিছু মরদেহ সে সময় খোলা মাঠে ফেলে রাখা হয়। বিকৃত হয়ে যাওয়ায় সেগুলোও আর উদ্ধার করা যায়নি। আইনবিশেষজ্ঞদের মতে, বুলডোজার দিয়ে অচিহ্নিত কবরে মরদেহ চাপা দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। অসংখ্য ফিলিস্তিনি জিকিমের কাছে নিখোঁজ হন। ওয়াদি তাদের একজন। এসব ফিলিস্তিনির ভাগ্যে কী জুটেছে, আজও অজানা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ট্রাকগুলো কোনো রাস্তা দিয়ে যাবে তা কঠোরভাবে নির্ধারণ করে এবং অনেক সময় তাদের এমন রুট নিতে বাধ্য করে, যা বিপদে ভরা। কিছু রাস্তা শক্তিশালী স্থানীয় পরিবার অথবা পাড়া-কমিটির সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া ব্যবহার করা যায় না, কিছু রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করে সশস্ত্র গোষ্ঠী। এসব কারণে কয়েক কিলোমিটারের পথও অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। এভাবেই ত্রাণ গাজার সেই ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’-এ হারিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। বিপদের কারণে ট্রাকগুলোর তারা সঙ্গে থাকতে পারে না, মাল খালাসের সময় তদারকি করতে পারে না। এ ছাড়া প্রতিটি চালান নজরদারি করার মতো পর্যাপ্ত কর্মীও নেই। স্থানীয় কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা এমন এক ব্যবস্থার ওপর ভর করে আছে, যেখানে বিদ্যমান অসংখ্য ফাঁকফোকর বিভিন্ন পক্ষ খুব দ্রুত নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়। এসবের মধ্যেও একটি বড় প্রশ্ন রয়ে যায় : এই সহায়তা নিখোঁজ হওয়ার ফলে প্রকৃত লাভবান হচ্ছে কারা? এই তালিকায় দ্রুত লাভের আশায় থাকা ব্যাবসায়ীরা আছে। আছে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা অর্থের উৎস খুঁজছে। আর আছে স্বয়ং দখলদার শক্তি ও তাদের মিত্ররা, যারা রাজনৈতিক চাপ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার করতে চায়। সবাই মিলে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণাকেই পুঁজি করে লাভ তুলছে। সমস্যা হচ্ছে, যুদ্ধবিরতির পর থেকে গাজায় যা ঘটছে তার প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগ অনেক কমে গেছে। বিশ্বের মানুষ মনে করছে গণহত্যা শেষ হয়েছে, তাই আর জিজ্ঞেস করছে নাÑ কেন সহায়তা ফিলিস্তিনিদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।
সিএনএনের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্রসিংয়ের কাছে থাকা ত্রাণপ্রত্যাশীরা ইসরায়েলি সেনাদের নির্বিচার ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন। জিকিমের আশপাশের শত শত ছবি ও ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ত্রাণবাহী ট্রাকের চালকদের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যালোচনা করা হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতেও ত্রাণপ্রত্যাশীরা যে এলাকায় নিহত হয়েছেন, সেখানে বুলডোজারের তৎপরতা চোখে পড়েছে। ইসরায়েলের দুজন সাবেক সেনাসদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে সিএনএন। তারা যুদ্ধের সময় গাজার অন্যত্র ঘটে যাওয়া এমন সব ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মরদেহ অগভীর কবরের মধ্যে বুলডোজারের মাধ্যমে চাপা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তারা নাম-পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) মরদেহ সরাতে বুলডোজার ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছে।
তবে মাটিচাপা দেওয়ার সময় বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেনি। সেখানকার দৃশ্য দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যে মরদেহ উদ্ধার করেছি, তা পচে গেছে। মরদেহগুলো অনেক দিন পড়ে ছিল। আইডিএফ সিএনএনকে জানিয়েছে, জিকিমের আশপাশে বুলডোজারের উপস্থিতি ‘নিয়মিত কার্যক্রমের’ অংশ ছিল, যা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতো। ‘অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট’-এর সহপরিচালক জেনিনা ডিল বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলোকে মরদেহ এমনভাবে কবর দেওয়ার জন্য সহযোগিতা করা উচিত, যাতে সেগুলো শনাক্ত করা যায়।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন