বাণিজ্যিক, শৈল্পিক ঘরানা- সব ধরনের সিনেমা ও সিরিজে অভিনয় করেছেন তিনি। পর্দায় পাওয়া গেছে নানা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে। তিনি আর কেউ নন, হুমা কুরেশি। বলিউডের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যেত, সালমান খানের ছোট ভাই সোহেল খান ও সীমা সচদেবের ডিভোর্সের নেপথ্যে নাকি হুমা কুরেশি! সে সময়ে ‘ঘর ভাঙানি’ কটাক্ষও শুনতে হয় তাকে। কিন্তু কটাক্ষ, সমালোচনার মুখে ‘টুঁ’ শব্দটি করেননি অভিনেত্রী। এবার চুপিসারেই বলিউডের এক অভিনয় প্রশিক্ষকের সঙ্গে আংটি বদল করে বাগদান সারলেন হুমা কুরেশি! যদিও অভিনেত্রীর তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু ঘোষণা করা হয়নি, তবে জল্পনার সূত্রপাত তাদের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর পোস্ট থেকেই।
কার বাগদত্তা হলেন হুমা? কৌতূহল অস্বাভাবিক নয়! খবর, অ্যাক্টিং কোচ রচিত সিংয়ের সঙ্গে সম্প্রতি আংটি বদল করেছেন অভিনেত্রী। আর বলিপাড়ায় সে খবর চাউর হয়েছে উভয় পক্ষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকাসা সিংয়ের তরফে। আকাশা তার ইনস্টা স্টোরিতে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। সেখানেই রচিত এবং হুমাকে রং মিলান্তি কালো পোশাকে দেখা গেল। তবে জল্পনাযজ্ঞে ঘৃতাহূতি করার নেপথ্যে আকাসার লেখা ক্যাপশন। কী রয়েছে তাতে? ছবির একেবারে উপরে লেখা, তোমাদের ছোট্ট স্বর্গরাজ্যের জন্য শুভেচ্ছা। আজকের রাতটা দারুণ কাটুক।’ সেই ছবিতেই মধ্যমণি হুমা কুরেশির হাতের আঙুলে উঁকি দিচ্ছে হিরের আংটি। এর পর দুয়ে দুয়ে ‘চার’ করতে আর বাকি নেই বলিউডের কারও।
গুঞ্জন, দীর্ঘদিন ধরেই বলিউডের অ্যাক্টিং কোচ রচিত সিংয়ের সঙ্গে প্রেম করছিলেন হুমা কুরেশি। প্রিয় বন্ধু সোনাক্ষী-জাহিরের বিয়ের রিসেপশনেও রচিতের সঙ্গে রং মিলান্তি পোশাকে এসেছিলেন হুমা। এবার প্রশ্ন কে এই রচিত সিং? জানা গেছে, আলিয়া ভাট, বরুণ ধাওয়ান, ভিকি কৌশল থেকে অনুষ্কা শর্মা, সইফ আলী খানের মতো তাবড় তারকাদের অভিনয় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন রচিত। রবিনা ট্যান্ডনের ‘কর্মা কলিং’ সিরিজেও অভিনয় করেছেন তিনি। তারকাদের সেই অভিনয় শিক্ষকের সঙ্গেই এবার হুমার বাগদান সারার গুঞ্জনে তোলপাড় বলিউড।
বহু বছর আগে শাহরুখ খান ও গৌরী খানের এক ঘরোয়া পার্টিতে হুমা ও রচিত একসঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগ দিয়েছিলেন। সেই থেকে সবাই তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা সবার নজরে আসে। এর আগে হুমা কুরেশি পরিচালক মুদাসসার আজিজের সঙ্গে চার বছর ধরে সম্পর্কে ছিলেন। তাদের সম্পর্ক বলিউড মহলে অনেকবার আলোচনায় আসে। তবে ২০২২ সালে হঠাৎ করেই সেই সম্পর্কের ইতি ঘটে। এরপর থেকেই হুমা নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখেন।
বর্তমানে রচিত সিং-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক যেন নতুন এক অধ্যায় খুলে দিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন, হুমা পেশাদার জীবনে ভীষণ মনোযোগী। ১৯৮৬ সালের ২৮ জুলাই জন্ম হুমা কুরেশির।
বাবা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। হুমা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রথমে তিনি থিয়েটার অভিনেত্রী এবং মডেল হিসেবে কাজ করেন। বিভিন্ন নাটকের প্রযোজনার কাজ করার পর, তিনি দিল্লি থেকে মুম্বাই চলে যান এবং টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করার জন্য হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
স্যামসাং মোবাইলের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে দৃশ্যধারনের সময় প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ তার অভিনয় ক্ষমতা লক্ষ্য করে মুগ্ধ হন। এরপর অনুরাগ তার নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য হুমাকে চুক্তিবদ্ধ করেন।
বাবা রেস্টুরেন্টে ব্যবসায়ী হলেও হুমার মন ব্যবসায় নয়, ছিল অভিনয়ে। তার এক ছোট ভাই সাকিবও বড় বোনের পথ অনুসরণ করে এখন অভিনয়ে। হুমার নতুন সিনেমা ‘বয়ান’ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই সিনেমাটি টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং বুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হবে। এই প্রসঙ্গে হুমা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি প্রকল্প, যা আমার মনের খুব কাছের। ভারতীয় গল্পকে আন্তর্জাতিক দর্শকের সামনে তুলে ধরা আমার কাছে গর্বের।’
একজন নারী পুলিশের জীবনের গল্প নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ‘বয়ান’। সিনেমাটি প্রধান ভূমিকায় রয়েছেন তিনি। ৩৯ বছর বয়সি হুমা বলিউডে শুরুতেই ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ সিনেমার দুই পর্বে মোহসেনা চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের সুবাদে চমকে দিয়েছিলেন দর্শক সমালোচক সবাইকে। তখনই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন প্রবলভাবে।
সিনেমাতে সু-অভিনয়ের জন্য সেরা সম্ভাবনাময় নবাগত অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন তিনি। এরপর দেড় ইশকিয়া, বাদলাপুর, বেলবটম, জলি এলএলবি টু, ডাবল এক্সেল, এক থি ডায়ান, ডি ডে, লাভ সাভ চিকেন খুরানা, মনিকা ও মাই ডার্লিং, তরলা প্রভৃতি সিনেমাতে তার চমৎকার অভিনয় দেখেছেন দর্শক।
বড় পর্দার পাশাপাশি ওটিটিতেও হুমার সদম্ভ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। সনি লিভের ঝড় তোলা ওয়েব সিরিজ ‘মহারানী’র প্রধান ভূমিকায় তার অনবদ্য অভিনয় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এই ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন হুমা। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘মহারানী’র চতুর্থ কিস্তিতেও অভিনয় করছেন তিনি। আরেকটি আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘মিথ্যা’য় তার শক্তিশালী পারফরম্যান্স মুগ্ধ করেছে সবাইকে।
সমালোচকেরা মনে করেন, বলিউডের প্রতিকূল পরিবেশে নিজের মতো করে দাঁড়িয়ে যারা কাজ করছেন, হুমা কুরেশি তাদের জন্য অনুপ্রেরণার নাম। এ প্রসঙ্গে হুমা বলেন, ‘আমার সামনে দুটি রাস্তা খোলা ছিল। একটা হলো সৌন্দর্য বাড়াতে একের পর এক কসমেটিক সার্জারি করা আর পরিচালকের কলের অপেক্ষায় থাকা। আরেকটা হলো ভালো চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে সাহসী চরিত্রে কাজ করে যাওয়া। আমি দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিয়েছি।’
সাহসী চরিত্র করে তিনি যে সফল, বলাইবাহুল্য। এ বছর তাকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মালিক’ সিনেমাতে একটি আইটেম গানে পারফর্ম করতে দেখা গেছে। এ সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে হুমা কুরেশি অভিনীত ‘জলি এলএলবি থ্রি’ সিনেমাটি। এখানে অক্ষয় কুমারের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আবার। এর আগের সিনেমাটিতে পুষ্পা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সবার মন জয় করেছিলেন মেধাবী এই অভিনেত্রী। এবারও সেই একই চরিত্রে পর্দায় উপস্থিত হয়েছেন তিনি।
শুধু বলিউডের সিনেমাতেই নয়, দক্ষিণী সিনেমায়ও হুমার পদচারণা রয়েছে। সেখানকার বেশকিছু সিনেমাতে তার অভিনয় ঝড় তুলেছে দর্শকমহলে। এই মুহূর্তে তার হাতে বেশ কিছু নির্মাণাধীন সিনেমা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বহুল আলোচিত প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা ‘টক্সিক’, ‘পূজা মেরে জান’, ‘গুলাবি’ সিনেমাগুলো।
সমালোচকেরা বলেন, বলিউডে বাইরে থেকে এসে নিজেদের জায়গা করে নেওয়া সহজ নয়। আর বহিরাগত যদি হন নারী, তাহলে পথটা আরও কঠিন। তবে সেই কঠিন পথ পাড়ি দিয়েই আজ বলিউডে নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছেন হুমা কুরেশি। তারকা-সন্তান নন, বলিউডে পেছনে কেউ ছিল না, ছিল কেবল প্রতিভা আর অদম্য মনোবল।
এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি অকপটে তার পথচলার কথা বলেন হুমা। জানালেন, কতটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাকে এগোতে হয়েছে। হুমার কথায়, ‘ইন্ডাস্ট্রির বাইরের একজন নারী হিসেবে আমার বলিউডযাত্রা মোটেই সহজ ছিল না।
আজও এমন অনেক চরিত্র আছে, যেগুলো আমি নিখুঁতভাবে করতে পারি, তবু আমাকে ডাকা হয় না। কিন্তু আমি কি বসে কাঁদব? সুযোগ না পাওয়ার জন্য হা-হুতাশ করব? মোটেও না, আমি নিজের শর্তেই কাজ করছি এবং তা চালিয়ে যাব।’
হুমা মনে করেন, বলিউডে এখনো নারীদের নিয়ে এক রকমের ছকে বাঁধা মানসিকতা কাজ করে। তিনি বলেন, ‘মহারানী আর তরলার মতো সফল কাজের পর এক কাস্টিং ডিরেক্টর আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, তুমি এত সুন্দর, তুমি কেন এমন চরিত্রে অভিনয় কর, যেখানে নিজেকে বয়সি দেখাও? পরিচালকেরা নাকি তরুণী চরিত্রে আমাকে কাস্ট করতে চান, কিন্তু আমি পর্দায় বয়সের ভার নিয়ে চরিত্র করায় নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি। কী বিচিত্র মানসিকতা! মেয়েদের নিয়েই কেন এই চাপ, যেন তারা নিজেদের চেয়ে ১০ বছর ছোট দেখাবেন পর্দায়।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে হুমা আরও বলেন, ‘গাছগাছালির পাশে দাঁড়িয়ে নাচের দৃশ্যে কাজ করেছি অনেক। কিন্তু এখন আর সেই পথে হাঁটতে চাই না। ভালো চিত্রনাট্য পেলে আমার বয়সের চেয়ে বড় চরিত্রে অভিনয় করতেও রাজি। তাতে ভয় নেই।’
সাহস আর আত্মবিশ্বাসের এমন নজির বলিউডে খুব বেশি দেখা যায় না। হুমা কুরেশি আজ সেই বিরল উদাহরণগুলোর একটি। কাউকে সন্তুষ্ট করতে নয়, হুমা কাজ করেন নিজের মর্জিমতো। তার ভাষ্যে, ‘কেবল সুন্দর আর আবেদনময়ী হওয়ার জন্য আমি বলিউডে পা রাখিনি। পুরুষ বা সমাজের চোখে নিজের দিকে তাকাই না। নিজের শরীর, নিজের সৌন্দর্য আর নিজের কাজকে উদযাপন করতে আমি জানি। সে জন্য আমার কারও কাছ থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।’