ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

বাপ জেলে, পলাতক ছেলে

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২৫, ১১:৩৭ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

রাজনীতিবিদ বাবার ক্ষমতার দাপটে সন্তানরা ছিলেন বেপরোয়া, আরাম-আয়েশ আর ভোগবিলাসে দিনযাপন করতেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াতেন মানবিকতার বুলি। ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে করেছেন নানা অনৈতিক কাজ।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর সেই রাজনীতিবিদ বাবারা এখন জেলে, আর তাদের সন্তানরা পলাতক। বাবারা কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করলেও দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বিদেশে আয়েশেই আছেন ক্ষমতার দম্ভ দেখানো সেসব রজনীতিবিদদের সন্তানরা। 

চট্টগ্রামে বাবাকে কারাগারে রেখে বিদেশের মাটিতে বিলাসী জীবনযাপন করা সন্তানদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম-৬ আসন রাউজানের সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর পুত্র ফারাজ করিম চৌধুরী।

চট্টগ্রাম-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পুত্র মাহবুব উর রহমান রুহেল এবং চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমএ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ। আইনশৃখলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে গেছেন সাবেক তিন সংসদ সদস্যের পুত্ররা। 

গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন চট্টগ্রাম-৬ আসন রাউজানের সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে পালিয়ে যাবার সময় আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী এই রাজনীতিবিদকে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

বৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার অপরাধে ফজলে করিম চৌধুরীর সাথে আটক হন আখাউড়ার নূরপুর এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মো. হান্নান মোল্যা, স্থানীয় বাসিন্দা ও মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মো. নাঈম চৌধুরী।

আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর গত ১৯ আগস্ট ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা করেন রাউজানের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজদৌলাহ। দুই বছর আগে অপহরণেরপর মুক্তিপণ আদায় করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ এনে এই মামলা করেন তিনি। 

ফজলে করিম চৌধুরী গ্রেপ্তারের আগেই আত্মগোপনে যান এমপি বাবার দাপুটে ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী। অথচ গলির মুখের দোকানদার থেকে করপোরেট জগতের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজকর্মীদের ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে তটস্থ রাখতেন রাউজানের স্বঘোষিত এই যুবরাজ।

পিচঢালা সড়কে ইট-সিমেন্ট থেকে শুরু করে রাউজানবাসীর শয়ন কক্ষের দেয়ালে কোন রং লাগানো হবে তাও নির্ধারণ করতেন এই ফারাজ। প্রচলন আছে, রাজনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ যে তার বিরুদ্ধে যেত তাদের সবাইকে মেহমান হতে হতো তার হাতে গড়া বিশাল বাহিনীর টর্চার সেলে।

মানবিকতার মুহুমুর্হু বুলি আউড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে নিজেই দিতেন নিজের উপাধি। ঘরের ওঠনে বিচার বসিয়ে সেই বিচারের দৃশ্যের লাইভে প্রচার করতেন বুক ফুলিয়ে। আবার সেই বিচারের বিচারকও তিনি। অপরাধ না করেও স্বঘোষিত এই যুবরাজের রোষাণলে পড়ে সামাজিকভাবে একঘরে হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রভাবশালী পিতার প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা রাউজানের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিলেন ফারাজ করিম চৌধুরী। নিজের গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে বৃদ্ধ বাবাকে দেশে রেখে পালিয়ে যান তিনি।

সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে গত বছর ২৭ অক্টোবর, রোববার ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ। পরে মীরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানায় দায়ের করা পাঁচ মামলাসহ ৯ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

এ ছাড়া ২০১৭ সালে কক্সবাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা, বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য ইশরাক হোসেনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে একাধিক মামলা রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ছয়বারের সংসদ সদস্য। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম এই রাজনীতিবিদ আওয়ামী শাসনামলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এই রাজনীতিবিদ দিনে দিনে হয়ে উঠেছিলেন মীরসরাইয়ের একক শাসনকর্তা। তার এই একনায়কতন্ত্রের কারণে ভীতস্থ থাকতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বার্ধক্যের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনীতির মাঠ থেকে সরে আসেন তিনি। নিজের আসনে বসান ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলকে।

কথিত আছে, মীরসরাই ইকোনমিক জোনের উন্নয়নের নামে হাজার কোটি টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন রুহেল। বাবার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়ে নির্বিচারে জেল খাটিয়েছেন রুহেল। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গ্রেপ্তারের আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান রুহেল। যে বাবার হাত ধরে রাজনীতির মাঠে নিজেকে সিদ্ধ করেছিলেন রুহেল অসময়ে তিনিও নেই বাবার পাশে।   

ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলে সমালোচিত নাম চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমএ লতিফ। প্রকাশ্য দিবালোকে মূল সড়কে ‘হায় মুজিব, হায় মুজিব’ বলে পিঠে চাবুক চাপড়ানো রাজনীতিবিদ। গত বছর ১৬ আগস্ট ভোরে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত এরশাদ নামে একজনের ডবলমুরিং থানায় করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। এই মামলায় এমএ লতিফসহ নামীয় ১৬ জনসহ অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করা হয়। এমএ লতিফ চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের চারবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

রাজনীতিতে খুব বেশি মাথা না ঘামালেও বাবা এমএ লতিফের ছত্রছায়ায় চট্টগ্রামের ব্যাবসায়িক সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন তারই ছেলে ওমর হাজ্জাজ। সর্বশেষে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হয়েছিলেন নির্বাচন ছাড়াই। শতবর্ষী এ সংগঠকে ‘কব্জা’ করতে যে রাজনীতিবিদ নিজের ছেলেকে বসিয়েছিলেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সর্বোচ্চ পদে তার দুঃসময়ে তারও পাশে নেই তার সন্তান।