বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘১৯৭১ সাল ছিল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ। আর ২০২৪ সালে ছিল স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ। ৭১ সালের শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ ভোলেনি। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের শহিদদেরও বাংলাদেশ ভুলবে না।’ গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের বর্ষপূর্তিতে গতকাল মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় এ কথা বলেছেন তারেক রহমান। এ সময় তিনি বাংলাদেশে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে না, কাউকে গণতন্ত্র হত্যা করার সুযোগ দেওয়া হবে না বলেও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী। সেই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনটি বাংলাদেশ উদযাপন করছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে।
তারেক রহমান বলেন, হাজারো শহিদের রক্তস্নাত রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে আর কখনোই তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেওয়া হবে না ইনশাআল্লাহ। আমি মনে করি, এসব প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য বহাল আছে, থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আজ এবং আগামীর প্রতিটি ৫ আগস্ট হয়ে উঠুক গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার অঙ্গীকারের দিন। এই সুমহান অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দীর্ঘ যাত্রায় আমি এবং আমার দল বিএনপি দেশের সব গণতন্ত্রকামী জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতা আশা করছে।
তারেক রহমান বলেন, ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত’ বাংলাদেশে যার যার দলীয় আদর্শ এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘ইস্যুভিত্তিক ভিন্নমত’ থাকবে। এটি বিরোধ নয়, বরং ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’। তবে ভিন্নমত কিংবা বিরোধের মাত্রা যেন ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ, চরমপন্থার উত্থান কিংবা পুনর্বাসনের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। সে ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি সতর্ক থাকার জন্য বিনীত আহ্বান জানাই।
আমি মনে করি, প্রতিটি রাজনৈতিক দল যার যার দলীয় কর্মসূচি কিংবা এজেন্ডা নিয়ে জনগণের আদালতে যাবে। জনগণ কোনটি গ্রহণ করবে কিংবা কোনটি বর্জন করবে এটি সম্পূর্ণ জনগণের এখতিয়ার। এভাবেই প্রতিদিনের রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে জনগণ যতক্ষণ নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে না পারবে, সরকার গঠন কিংবা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা অর্জন করতে না পারবে, তত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র এবং সরকারে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। আসুন রাষ্ট্র-সরকার, শাসন-প্রশাসন পরিচালনায় আর প্রতিদিনের কার্যক্রমে জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার চর্চা-প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলি। জনগণকে শক্তিশালী করে তুলতে না পারলে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই শক্তিশালী এবং টেকসই হবে না।
তারেক রহমান বলেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যাওয়ার পরপরই বীর জনতার উদ্দেশে অভিনন্দনবার্তায় আমি বলেছিলাম, বিজয়ীর কাছে পরাজিতরা নিরাপদ থাকলে বিজয়ের আনন্দ মহিমান্বিত হয়। সেটি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আহ্বান, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। মব-ভায়োলেন্সকে উৎসাহিত করবেন না, নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করবেন না, অন্যের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।
একজন মায়ের চোখে বাংলাদেশ যেমন, আমরা তেমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই। যেখানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী, প্রতিটি সন্তান, প্রতিটি মানুষ নিরাপদে থাকবে। বিগত দেড় দশকের ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের সময়কাল ছাড়া আর কোনো শাসনামলের তুলনা চলে না বলে মনে করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, আমি সবাইকে বিনীতভাবে আহ্বান জানাব, হিটলারের নাৎসিবাদ সম্পর্কে যেমন কেউ গৌরব করে না, পলাতক ফ্যাসিস্টের শাসনকাল নিয়েও গৌরব করার কিছুই নেই। ডাকাতি করে কিছু সম্পদ চ্যারিটি করলেও জনগণের চোখে ডাকাত যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা খুঁজতে গিয়ে কৌশলে পলাতক ফ্যাসিস্টদের পক্ষে সাফাই গাওয়াও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
যারা কৌশলে ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তুলনা করতে চান, তাদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যা ঘটেছে, এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, ‘বিশ্বের ইতিহাসেও মনে হয় নজিরবিহীন।’ ফ্যাসিস্টের দোসররা গা-ঢাকা দিয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্রের মনে এখনো কোনো অনুতাপ অনুশোচনা নেই।
তারেক রহমান বলেন, একাত্তর সালের শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ ভোলেনি, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শহিদদেরকেও বাংলাদেশ ভুলবে না। একাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীনতা রক্ষা, স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনÑ এভাবেই ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে লাখো মানুষ শহিদ হয়েছেন। আজকের এই দিনে আমি আবারও সব শহিদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি।
দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহিদরা দেশবাসীকে ‘ঋণী’ করে গেছেন মন্তব্য করে বিএনপি নেতা বলেন, এবার শহিদদের প্রতি আমাদের ঋণ পরিশোধের পালা। দেশের জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ইনসাফভিত্তিক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমেই আমরা শহিদদের ঋণ পরিশোধ করতে পারি।