ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গ্রাহকের টাকা ১৯ কোম্পানির পকেটে

রহিম শেখ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫, ১১:৫৪ পিএম

বিমা আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনার নামে অতিরিক্ত টাকা খরচ করছে দেশের জীবন বিমা (লাইফ) কোম্পানিগুলো। এতে বিমা গ্রাহকদের দাবি নিষ্পত্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থও ক্ষুণœ হচ্ছে। জীবন বিমার ৩৬টি কোম্পানির ২০টি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। আর গ্রাহকের প্রিমিয়ামের অর্ধেকের বেশি অর্থ খেয়ে ফেলেছে ১৯টি জীবন বিমা কোম্পানি।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের সরকারি-বেসরকারি ২০টি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে অনুমোদিত ব্যয়সীমার চেয়ে ১৫৯ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। কমিশন, বেতন-ভাতা, অফিসভাড়া ও নানাবিধ খাত দেখিয়ে এই অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। 

বাংলাদেশে জীবন বিমা কম্পানির ব্যয়ের বিষয়ে বিমা আইন, ২০১০ এবং বিমা বিধিমালা অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ব্যয় এবং গ্রাহকের অর্থ অপচয় করা যাবে না। আইন বলছে, অতিরিক্ত ব্যয় অবৈধ। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর মতে, এ টাকা বিমা গ্রাহকের; তাই অতিরিক্ত ব্যয় অবৈধ। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ওই সীমা লঙ্ঘন করে জীবন বিমার ৩৬ কোম্পানির মধ্যে ২০টি অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। অতিরিক্ত অর্থ তছরুপ করতে শীর্ষ অবস্থানে থাকা জীবন বিমার দুই কোম্পানি পদ্মা লাইফ ও সানলাইফ ইনস্যুরেন্স। এই দুই  কোম্পানি নির্ধারিত ব্যয়সীমার দ্বিগুণের বেশি ব্যয় করেছে। এ ছাড়া প্রিমিয়ামের চেয়েও বেশি ব্যয় করেছে স্বদেশ লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি। ২০২৪ সালের নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করা এসব কোম্পানির অনিরীক্ষিত হিসাব থেকে এসব তথ্য জানা যায়। এমন অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ২০২৩ সালে বিধি লঙ্ঘনের দায়ে এই খাতের বেশ কিছু কম্পানিকে বড় অঙ্কের জরিমানাও করেছিল আইডিআরএ।

এর পরও ঝুঁকিতে থাকা এসব  কোম্পানি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বাড়িয়ে তুলছে। জীবন বিমায় সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এর মধ্যে টাকার অঙ্কে সীমার অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ব্যয় বাড়িয়েছে এস আলম গ্রুপের কম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স  কোম্পানি। সর্বোচ্চ ঝুঁকির তালিকায় নাজুক অবস্থায় থাকা এ কোম্পানিটি ৪৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। জীবন বিমা খাতে মাত্র ১৬টি কোম্পানি গত বছর ব্যয়সীমার মধ্যে ছিল। এর মধ্যে ৯০ কোটি টাকা ব্যয় কম করেছে ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। ন্যাশনাল লাইফসহ ১৬ কোম্পানি ব্যয় কমিয়েছে প্রায় ১৬৬ কোটি টাকা।

আইডিআরএর বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করা কোম্পানির মধ্যে পদ্মা ইসলামী লাইফ ১১৭ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। আর ১০০ শতাংশের বেশি ব্যয় করা আরেক কোম্পানি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ৬২ শতাংশের বেশি ব্যয় করেছে। নির্ধারিত সীমার ৫০ শতাংশ বেশি ব্যয় করা কোম্পানি বায়রা লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ও স্বদেশ লাইফ। অতিরিক্ত ব্যয় ৪৪ শতাংশ করেছে সানফ্লাওয়ার লাইফ। এমন ব্যয়সীমা লঙ্ঘন করে ন্যূনতম থেকে ৫০ শতাংশের কম করেছে গোল্ডেন লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, যমুনা লাইফ, জেনিথ ইসলামী লাইফ, লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব বাংলাদেশ, চার্টার্ড লাইফ, জীবন বিমা করপোরেশন, বেস্ট লাইফ, মেঘনা লাইফ, সোনালি লাইফ ও ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালে জীবন বিমা খাতে গ্রস প্রিমিয়ামের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে ১৯ কোম্পানি। এর মধ্যে সাত কোটি ৬৩ লাখ টাকা গ্রস প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে স্বদেশ লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি গত বছর ব্যয় করেছে সাত কোটি ৯৫ লাখ টাকা। কোম্পানিটির প্রিমিয়ামের শতভাগের বেশিÑ অর্থাৎ ১০৪ শতাংশ ব্যয় করেছে। প্রিমিয়াম আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে ডায়মন্ড লাইফ। কোম্পানিটি ১৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা গ্রস প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে ১৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ হিসেবে প্রিমিয়ামের ৯৭ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়েছে।

৩৫ কোটি টাকা গ্রস প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে এনআরবি ইসলামী লাইফ ৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। কোম্পানিটির প্রিমিয়াম অনুপাতে ব্যয় হার ৯৩ শতাংশ। প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্স ৪০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ব্যয় করেছে ৩৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এই কোম্পানি প্রিমিয়ামের প্রায় ৮৭ শতাংশ ব্যয় করেছে। ২৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হোমল্যান্ড লাইফ ২৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে। এ হিসাবে কোম্পানিটি ৮২ শতাংশের বেশি ব্যয় করেছে। আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, সীমার অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ২০২৩ সালে বেশ কয়েকটি বিমা কোম্পানিকে জরিমানা করেছে আইডিআরএ। এসব জরিমানার পরের বিমা খাতের কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত ব্যয় করে চলছে।

আইডিআরএর তথ্য মতে, ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্সের কাছেই গ্রাহকের পাওনা দুই হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। অথচ এই কম্পানিটির ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা ছিল ৭২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অথচ ব্যয়সীমা অতিক্রম করে ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। গ্রাহকের টাকা সঠিকভাবে পরিশোধ না করেও সীমার অতিরিক্ত ৪৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করেছে।