বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে ছোট হচ্ছে দেশের শ্রমবাজার। গত এপ্রিলে ৪৯ হাজার ৯৮৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন।
আগের মাস মার্চের তুলনায় ৪৭ শতাংশেরও বেশি কমেছে, আর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ৫৮ শতাংশ, যা বিগত ৪৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এপ্রিলে বাংলাদেশি কর্মীদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরবে কর্মী যাওয়া মার্চের তুলনায় ৩৫ শতাংশের বেশি কমে যাওয়ায় প্রবাসী কর্মসংস্থানে এই ধস নেমেছে। এর মূল কারণ হলো, একক ভিসাধারীদের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের বাধ্যতামূলক সত্যায়ন, যা জানুয়ারির শেষদিক থেকে কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
শ্রম বাজার সম্প্রসারণে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রধান উপদেষ্টার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিদেশে যান ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ কর্মী। ২০২৩ সালে বিদেশে যান ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯০ কর্মী। ২০২৪ সালে যান ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই গেছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৯৭ হাজার ৮৬৭ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ৪৩৬ জনে। তবে মার্চে রেকর্ড ১ লাখ ৫ হাজার ৩৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন।
সর্বশেষ এপ্রিল মাসে রেকর্ড পরিমাণে কমে বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৮৩ জন। এপ্রিলে জনশক্তি রপ্তানির যে তথ্য এসেছে, তাতে আগের মাস মার্চের তুলনায় ৪৭ শতাংশেরও বেশি কমেছে, আর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ৫৮ শতাংশ, যা বিগত ৪৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এর আগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৮ জন। তিনটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এগুলো হলো মালয়েশিয়া, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এ ছাড়া সৌদি আরব ও কাতারের মতো দেশগুলোতে নিয়োগ কমে যাওয়ায় এবং মালয়েশিয়া, ওমানের পাশাপাশি বাহরাইনের শ্রমবাজারও বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
এর মাঝে অবশ্য সরকার নতুন শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা করছে, তবে তাদের সাফল্যকে এখনো পর্যাপ্ত বলা যায় না। বিদ্যমান বাজারগুলো চালু করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ মালয়েশিয়ায় সাড়ে তিন লাখ কর্মী রপ্তানি হলেও ২০২৪ সালে এক লাখেরও কম কর্মী পাঠানো হয়েছে। ২০২৩ সালে সোয়া লাখের বেশি কর্মী পাঠানো হয় ওমানে।
২০২৪ সালে সেখানে মাত্র ৩৫৮ জন কর্মী পাঠানো হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০২৩ সালে প্রায় এক লাখ কর্মী রপ্তানি করা হয়। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৭ হাজারে। দক্ষ কর্মী না থাকায় দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানেও বাংলাদেশি কর্মী কম যাচ্ছে। রাশিয়া, পর্তুগাল, মাল্টা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, কঙ্গো, ইরাক ও ইরানে নতুন করে কর্মী পাঠাচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর জনশক্তি ব্যবসায়ীরা আশা করেছিলেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব হবে।
কিন্তু নতুন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা প্রবাসী কল্যাণ নিয়ে নানা সময়ে বক্তব্য দিলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ৫ লাখ কর্মী সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে রেকর্ড ৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৪ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। চলতি বছরের চার মাসে ২ লাখ ৩০ হাজার ২৫৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ২০২৩ সালে সাড়ে তিন লাখের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন।
২০২৪ সালে এক লাখেরও কম কর্মী দেশটিতে যেতে পেরেছেন। চলতি বছরের চার মাসে দেশটিতে ২ হাজার ১০০ কর্মী গেছেন। ২০২৩ সালে ওমানে সোয়া লাখের বেশি কর্মী যান, কিন্তু ২০২৪ সালে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় মাত্র ৩৫৮ জন কর্মী যেতে পেরেছেন। চলতি বছরের চার মাসে দেশটিতে কর্মী প্রেরণ করা হয়েছে মাত্র ৩১ জন।
২০২৩ সালে প্রায় এক লাখ কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন। তবে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজারে। চলতি বছরের চার মাসে দেশটিতে কর্মী প্রেরণ করা হয়েছে মাত্র ৩১ জন। চলতি বছরের চার মাসে দেশটিতে কর্মী প্রেরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৬২ জন। ২০২৪ সাল থেকে বাহরাইনে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। চলতি বছরের চার মাসেও দেশটি বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মীও নেয়নি।
দক্ষ কর্মীর অভাব ও বিকল্প শ্রমবাজার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী পাঠানোর হার একেবারেই কম। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান প্রতিশ্রুতিশীল শ্রমবাজার হলেও ভাষা ও পেশাগত দক্ষতার অভাবে অনেকেই সেখানে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছেন না।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। অথচ সে বছর মাত্র ৪ হাজার ৪৯৬ জন কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়। ২০২৪ সালে দেশটিতে গিয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৯১৮ জন। চলতি বছরের চার মাসে দেশটিতে মাত্র ৬০৫ জন কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘সরকার দাবি করে বাংলাদেশ থেকে ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে ৯৫ শতাংশ কর্মীই যাচ্ছে মাত্র ছয়টি দেশে। বাকি দেশে নামমাত্র কর্মী পাঠানো হচ্ছে, কোথাও তা মাত্র ২ থেকে ৩-৪ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে বাংলাদেশি ও মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের কারণে। অনেক কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ পাননি। ফলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। সরকারকে দ্রুত মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবকাঠামো খাত বন্ধ থাকায় কর্মী নিয়োগ কমে গেছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে গত বছর ৬ লাখ কর্মী যাওয়ায় (এ বছর) চাহিদা কমে গেছে বলে জানান এই গবেষক।
দেশের ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী বলেন, ‘শ্রমবাজারের সংকট কাটাতে হলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজারগুলো দ্রুত খুলতে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যায় পরামর্শ দিয়ে হায়দার আলী বলেন, ‘বিকল্প বাজার তৈরি না করা গেলে (দেশের) শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়বে। তখন মানুষ অবৈধভাবে সাগরপথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করবে, যা আরও বিপজ্জনক হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংকুচিত হয়ে যাওয়া কাতার ও সৌদির শ্রমবাজারে লোক পাঠানো আরও বাড়াতে হবে। থাইল্যান্ড সম্ভাবনাময় একটি বাজার ছিল, সেটিও বন্ধ। এটি চালু করতে দুই দেশের আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের সাত-আটটি বড় শ্রমবাজারের মধ্যে তিনটি বন্ধ রয়েছে। কাতার, কুয়েত ও সৌদি আরবেও কর্মী নিয়োগ কমেছে। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান গত এক বছর ধরে শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে। এসব বাজার খুলতে না পারলে কর্মী পাঠানোর হার আরও কমে যাবে।’
আপনার মতামত লিখুন :