১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন দেশের জন্মের পর ১৯৪৮, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়। পূর্ণমাত্রার এই তিনটি যুদ্ধের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দুটি যুদ্ধ হয়।
কাশ্মীর ইস্যুতে সীমান্তে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়। ১৯৯০-এর দশকে দুই দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে। তখন থেকে কাশ্মীরকে বিশ্বে অন্যতম ‘বিপজ্জনক সংঘাতময় অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হন। হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ। পুলওয়ামা কাণ্ডের ঠিক ১২ দিনের মাথায়, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করেছিল ভারতের বিমানবাহিনী। ২০১৯ সালের সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামকাণ্ডের পর দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত। ভারত এখনো প্রত্যাঘাত করেনি। তবে দেশব্যাপী ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ আবহে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি সেরে রাখার মহড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে এই মহড়া চালানোর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাজ্যের মুখ্য সচিবদের এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
যুদ্ধ বাধলে নাগরিকদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কী কী করণীয়, সেসবই ওই বার্তায় বলা হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রথমবার এ ধরনের মহড়ার নির্দেশ দিল। নির্দেশ কার্যকর করতে হবে প্রধানত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে। কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী, দেশের ২৪৪ জেলায় এই মহড়া চালানো হবে। মহড়া দিতে হবে গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও। এই মহড়ায় মূলত দেখা হবে শত্রুদেশের বিমান হামলার সময় সতর্কতামূলক সাইরেনব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, কিংবা রাতে হামলার আশঙ্কা রুখতে ‘ব্ল্যাক আউট’ব্যবস্থা কার্যকর অবস্থায় রয়েছে কি না। বিমান হামলা থেকে বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তৈরি বাংকারগুলো তৈরি রাখা হচ্ছে কি না ইত্যাদি।
বিমান হানা রুখতে ‘ব্ল্যাক আউট’ একটা কার্যকর ব্যবস্থা। শত্রুবিমানের আক্রমণের লক্ষ্য আড়াল করতে এলাকা নিষ্প্রদীপ রাখাই এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য, যাতে বিমানচালককে বিভ্রান্ত করা যায়। পাঞ্জাব সীমান্তের ফিরোজপুরে গত রোববার রাতে আচমকাই এই ‘ব্ল্যাকআউট’ মহড়া চালানো হয়। প্রস্তুতি হিসেবে সেতু, বিমানবন্দর, জাহাজবন্দর, তেলের ডিপো, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা ঢেকে রাখার কর্মসূচিও নেওয়া হয়, যাতে আকাশ থেকে তা দৃশ্যমান না হয়। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে এসব কাজ দ্রুত সেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহড়ার আরও এক উদ্দেশ্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় বেসামরিক নাগরিকদের শিক্ষিত করে তোলা। রাজ্যে রাজ্যে গঠিত সিভিল ডিফেন্স এই দায়িত্ব পালন করে। স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এনসিসি ক্যাডেটদেরও এই বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। লক্ষ্য, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সজাগ ও সচকিত রাখা। এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে রাজ্য সরকারকে বলা হয়েছে।
শত্রু হানায় হতাহত ব্যক্তিদের কত দ্রুত উদ্ধার করা যায়, সেটাও এই মহড়ার একটা অঙ্গ। সেই কাজে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে সব সময় জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আগে থেকেই বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। ১০ দিন ধরেই জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অঞ্চলে তৈরি হওয়া বাংকারগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষত পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কৃষকদের দ্রুত ফসল কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুটি কাজই স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসন যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে করছে। সীমান্তবর্তী এলাকার সড়ক মেরামতের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর খাদ্য ও পানীয় মজুতের দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে।
কাশ্মীরে সাম্প্রতিক হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সীমান্তে টানা ১২ দিন ধরে চলা গোলাগুলিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রণ রেখা। মঙ্গলবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর টানা ১২তম রাত গোলাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। এর জবাবে ভারতীয় সেনারাও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, জম্মু ও কাশ্মীরের কুপওয়ারা, বারামুল্লা, পুঞ্চ, রাজৌরি, মেন্ধার, নওশেরা, সুন্দরবানি এবং আখনুর সেক্টরের বিপরীতে পাকিস্তান সেনারা গুলি চালালে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা প্রতিরোধে অংশ নেয়। পাকিস্তান উপকূলে নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভারত অভিযোগ করে তাদের গুপ্তচর-বিমান শনাক্তের দাবি করেছে ইসলামাবাদ। এদিকে, ভারতের বাঁধে শুকিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের চেনাব নদী। একদিনের ব্যবধানে প্রবাহ কমেছে ৪ হাজার কিউসেক পানির। বাঁধের মাধ্যমে পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে নয়াদিল্লি।
এতে পানির সংকটে ক্ষতির মুখে পড়বে পাকিস্তানের কৃষি খাত। দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরসহ দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেছেন, ভারত হামলা চালালে তাৎক্ষণিকভাবে শক্ত জবাব দেওয়া হবে। পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক সমর্থনের কথা স্বীকার করেছেন। পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের সমস্যা সমাধানে জোর দেন অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
এদিকে জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই তৈয়বার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছেন জাতিসংঘের পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আসিফ ইফতিখার।
আপনার মতামত লিখুন :