বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও মুখে বলছে তাদের এই ঋণের প্রয়োজন নেই। আবার একই সময়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে বাংলাদেশের জন্য উন্নততর সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি স্থগিত হলে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এক ধরনের নেতিবাচক বার্তা যাবে। বিভিন্ন ঋণমানকারী প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় বাংলাদেশের মান কমে যেতে পারে। এতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বৈশ্বিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের ঋণ কর্মসূচি স্থগিত করতে পারে। ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের পথে অন্তরায় হতে পারে।
উল্লেখ্য, আগামী মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়ার কথা আছে। কিন্তু আইএমএফের সঙ্গে শর্ত পালন নিয়ে দর-কষাকষি চলছে, তবে এখনো সমঝোতা হয়নি। সমঝোতায় পৌঁছতে আইএমএফের সঙ্গে গত সোমবার বাংলাদেশ থেকে অনলাইন মিটিং করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। কিন্তু তারা কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেননি। এ জন্য গতকাল মঙ্গলবার একইভাবে মিটিং করছেন তারা। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ স্থগিত হলে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যে নেতিবাচক বার্তা যাবে, তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ আস্থা হারাতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে যে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলারের বাজেট-সহায়তার আলোচনা চলছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাত, করব্যবস্থা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বিনিময়হার নীতিসহ যেসব অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে সে সময় করা যায়নি। আইএমএফের কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে ওই সব সংস্কার করা তুলনামূলক সহজ হবে। এ ছাড়া বহির্বিশ্বে এক ধরনের বার্তা যাবে, বাংলাদেশের পাশে আইএমএফ আছে। নয়তো বিপরীত চিত্র দেখা দিতে পারে।
এপ্রিলের শেষ ভাগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ‘আমাদের আইএমএফের টাকার দরকার নেই, তবে টেকনিক্যাল সহযোগিতার প্রয়োজন আছে।’
তিনি বলেন, ‘আইএমএফের সাথে মতানৈক্য কম আছে। তবে আইএমএফের ঋণ ছাড়াও আমরা চলতে পারি। বর্তমানে আমাদের প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আছে। আইএমএফকে আমি বলেছি, আমরা টাকা নিতে চাই না। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অর্থের চেয়ে বড়। তাদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট, নীতিগত পরামর্শ ও অংশীদারত্ব আমাদের প্রয়োজন।’
গত রোববার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে চলমান ঋণ কর্মসূচি চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির সমাধানে এডিবি তাগিদ দিয়েছে। কারণ এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা বাজেট সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির বিষয়টি আমলে নেয়। তবে আইএমফের শর্ত মানা হবে না। এমনকি আইএমএফ ও এডিবি কেউ বাজেট সহায়তা না দিলেও নিজেদের মতো করে বাজেট দেওয়া হবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত নিয়ে দর-কষাকষি চললেও মূলত একটি শর্ত পরিপালনের ওপর চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় নির্ভর করছে। সেটি হলো বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হার পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো অনেকটা বেঁধে দেওয়া মুদ্রা বিনিময়হার কার্যকর আছে।
এ ছাড়া কৃষি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাতে সংস্কার এসব শর্তও আছে। অবশ্য এসব শর্ত ধাপে ধাপে পূরণ করছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত সোমবার সন্ধ্যায় ভার্চুয়াল উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। দেড় ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে কোনো সমঝোতা হয়নি; আরও আলোচনা চলবে।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। মোট ৭ কিস্তিতে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
এদিকে গতকাল অর্থ উপদেষ্টা এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতো কান্দাসহ অন্য প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, ‘নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বচ্ছতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের পথে এক ঐতিহাসিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটপূর্ণ সময়ে শুধু অর্থায়ন নয়, কাঠামোগত সংস্কার ও দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এডিবির ভূমিকা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
উপদেষ্টা চারটি প্রধান খাত ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি-অবকাঠামো, ই-গভর্ন্যান্স ও ডিজিটাল শিক্ষা সম্প্রসারণে সহায়তা, জলবায়ু কার্যক্রমÑ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ুবান্ধব কৃষি এবং উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য এডিবিকে উন্নততর সহযোগিতার আহ্বান জানান। তিনি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য, শক্তি ও পরিষেবা ক্ষেত্রে আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার পরামর্শ, টেকসই অর্থায়ন ও ঋণ বজায় রেখে উন্নয়ন চাহিদা পূরণের জন্য ছাড়যুক্ত তহবিল ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
এ ছাড়া, আজকের সংকটকে আগামীর সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে হলে সাহসী চিন্তাধারা, গভীর অংশীদারত্ব ও সম্মিলিত সংকল্পের প্রয়োজন বলে তিনি জানান। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া, আগামীর প্রস্তুতি’ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও অনুপ্রেরণাদায়ক।
একই দিন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে।
গত পাঁচ দশকে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে আনুমানিক ৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে, যা মূলত দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আর্থিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের মূল উন্নয়ন অগ্রাধিকারের প্রতি জলবায়ু সহনশীলতা, মানবিক সহায়তা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি-সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কৌশল অনুসারে, এফসিডিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বাণিজ্য, জলবায়ু অর্থায়ন, এসএমই উন্নয়ন, ডিজিটাল প্রশাসন এবং শিক্ষা খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সবুজ বিনিয়োগ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, নদী পুনরুদ্ধার, বেসরকারি খাত, কারিগরি সহায়তা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা এবং যৌথ গবেষণায় সহায়তার আহ্বান জানায়।
আপনার মতামত লিখুন :