মঙ্গলবার, ০৬ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসানুর রহমান তানজির, খুলনা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২৫, ০৯:২৫ এএম

দাদা ম্যাচ কারখানার মেইন গেট লুট করেছে দুর্বৃত্তরা

হাসানুর রহমান তানজির, খুলনা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২৫, ০৯:২৫ এএম

দাদা ম্যাচ কারখানার মেইন গেট লুট করেছে দুর্বৃত্তরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

খুলনার ঐতিহ্যবাহী শিল্পপ্রতিষ্ঠান দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি আজ অব্যবস্থাপনা, অবৈধ দখল এবং লুটপাটের এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি। সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন এ কারখানার লোহার মেইন গেট কেটে নেওয়া, জমি ও পুকুর দখল, বেআইনি দেয়াল কেটে নতুন করে আরও একটি গেট নির্মাণের পাঁয়তারা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এবং দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা।

সম্প্রতি জেলা প্রশাসক ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া কয়েকটি লিখিত অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। আর দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে কোনো কার্যকর তত্ত্বাবধান না থাকায় দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিটির মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও মালামাল ধারাবাহিকভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধান না থাকায় এখন কারখানাটি যেন চোরচক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না দেখভালের দায়িত্বে থাকা খুলনা জেলা প্রশাসন।

প্রধান গেট কেটে লুট, নিরাপত্তাহীন ফ্যাক্টরি: সর্বশেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, ৩০% সরকারি (শিল্প মন্ত্রণালয়) ও ৭০% বেসরকারি (ভাইয়া গ্রুপ) মালিকানাধীন এ কারখানার লোহার মেইন গেটের একটি পাল্লা গত ২৮ এপ্রিল রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে যায় লুটকারীরা।

বাকি পাল্লাটিও যেকোনো সময় সরিয়ে ফেলা হতে পারে। খুলনা সদর থানায় অভিযোগ জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অভিযোগে আরও বলা হয়, কারখানার মূল কাঠামো এরইমধ্যে লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু ইটের গাঁথুনি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। দিনে-রাতে ধারাবাহিকভাবে দুর্বৃত্তরা কারখানার বিভিন্ন অংশ ভেঙে ইট পর্যন্ত সরিয়ে নিচ্ছে। একই সঙ্গে একটি প্রভাবশালী মহল সীমানা প্রাচীর ভেঙে জমি জবরদখলের চেষ্টায় লিপ্ত বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে খুলনা সদর থানার ওসি হাওলাদার সানোয়ার হুসাইন মাসুম বলেন, এ অভিযোগসংক্রান্ত বিষয়ে রূপসা ফাঁড়ির ইনচার্জ আমজাদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

বেআইনিভাবে দেয়াল কেটে নতুন করে আরও একটি গেট করার পাঁয়তারা করছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ : এর আগে ২৩ এপ্রিল দেওয়া একটি অভিযোগে বলা হয়, খুলনার দাদা ম্যাচ কারখানার ভেতরে থাকা ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফ্যাক্টরির একাধিক গাছ কেটে এবং সীমানা প্রাচীর ভেঙে তৃতীয় গেট নির্মাণ শুরু করেছে, যা অবৈধ এবং জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই করা হচ্ছে। বিষয়টি দ্রুত বন্ধে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৌশিক কুমার বর্মন বলেন, স্কুলের বাচ্চাদের চলার পথ সহজ করার জন্য গেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তে এসব করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন বা কারখানার কারো সাথে অবশ্য যোগাযোগ করা হয়নি। পরে খুলনা জেলা প্রশাসনের সদর ভূমি সহকারী কমিশনার এসে কাজ বন্ধ করে দিয়ে যান। এখনো কাজ বন্ধ রয়েছে। গাছ কাটা হয়েছে এটা সত্য। তবে বিক্রি করা হয় নাই। যাদেরকে জায়গা পরিষ্কার করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে তারা গাছগুলো নিয়ে যায়।

বেদখলে কারখানার পুকুর: আরেক অভিযোগে বলা হয়েছে, রূপসা উপজেলার কর্ণপুর কলোনিতে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির মালিকানাধীন ২৩ শতক জমির ওপর একটি পুকুর জবরদখল করেছে স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্র। মো. আবু বক্কার ও মো. আব্দুল মান্নান নামের দুই ব্যক্তি ওই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগে বলা হয়। অভিযোগকারীদের দাবি, পুকুরে প্রবেশ কিংবা মাছ ধরতে বাধা দিলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফ্যাক্টরির পক্ষ থেকে এই জমি ও পুকুর সরকারি নথিতে রেকর্ডভুক্ত বলে জানানো হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পুরো ফ্যাক্টরি চত্বরেই এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ, ভেঙে পড়া দেয়াল আর আগাছায় ঢেকে যাওয়া অবকাঠামো রয়েছে। ফাঁকা ও অরক্ষিত ফ্যাক্টরির ভেতর দিয়ে চোর চক্র লোহা, যন্ত্রাংশ, কাঠসহ মূল্যবান সামগ্রী দেদার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন কেউ না কেউ আসে টিন, লোহা, ইট এমনকি ফ্লোরের নিচ থেকে ধাতব বস্তু খুঁড়ে নিয়ে যায়। ফ্যাক্টরিটি বন্ধ হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের ওপর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হলেও, বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির এ অবস্থা খুলনার শিল্পঐতিহ্যের এক করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কারখানাটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের চিঠির ভিত্তিতে খুলনা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে থাকলেও সেখানে কার্যকর তদারকি না থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্বৃত্তরা লুটপাট ও দখলের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অভিযোগকারীরা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বারবার বিষয়গুলো জানানো হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, প্রতিদিন কিছু না কিছু চুরি হচ্ছে। এই ফ্যাক্টরির ভেতরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। অথচ প্রশাসন একেবারেই নীরব। তিনি আরও বলেন, এখানে যদি দ্রুত নিরাপত্তা জোরদার না করা হয়, তাহলে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির আর কোনো চিহ্নই ভবিষ্যতে থাকবে না।

সম্প্রতি গত ২৭ নভেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূরুন নাহারের নেতৃত্বে দাদা ম্যাচ কারখানার বর্তমান অবস্থা দেখতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), খুলনা জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন মিলে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এই জায়গায় এখন সময়োপযোগী কী করা যায় সে ব্যাপারে প্রতিবেদনে সুপারিশ করেন। কিন্তু চার মাস পার হলেও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না।

সার্বিক বিষয়ে খুলনা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, দাদা ম্যাচ কারখানার গাছ কেটে ও সীমানা প্রাচীর ভেঙে গেট নির্মাণের অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক সদর ভূমি সহকারী কমিশনার ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক আমরা ব্যবস্থা নেব। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম করতে হয়। কোনো অভিযোগ আসলে আমি সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি। এ ব্যাপারে কোনো গাফিলতি আছে কি না।

উল্লেখ্য, দাদা ম্যাচ কারখানাটি ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় এটি করা হয়। এই কোম্পানির ৭০ শতাংশের মালিকানা দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ভাইয়া গ্রুপের। আর বাকি মাত্র ৩০ শতাংশের মালিকানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন শেয়ারের প্রতিনিধিত্বে তার অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। ১৯৫৫-৫৬ সালে গেওয়া কাঠের ওপর নির্ভর করে খুলনার রূপসা নদীর তীরে ১৭.৩৫ একর জমির ওপর দাদা ম্যাচ ওয়ার্কস বা ফ্যাক্টরির যাত্রা শুরু হয়। এর মালিকানায় ছিল পাকিস্তানি দাদা গ্রুপ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয়করণ করা হয়।

খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করে সুইডিশ একটি কোম্পানি। পুরোনো মেশিনারিজসহ অব্যাহত লোকসানের ফলে ১৯৯৩ সালে সুইডিশ কোম্পানি তাদের ৭০ শতাংশ মালিকানা বিক্রি করে দেয়, যা সাফ কবলামূলে কিনে নেয় ভাইয়া গ্রুপ।

সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ২০১০ সাল পর্যন্ত চলে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। উপর্যুপরি লোকসান ও কথিত শ্রমিক নেতাদের ষড়যন্ত্রের কারণে ২০১০ সালে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!