জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাত্র আট মাসের ব্যবধানে দেশে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন অন্তত ২৬টি নতুন রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম। আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরও কয়েকটি দল। এই বিশালসংখ্যক দল আত্মপ্রকাশ করলেও দুই-একটি দল ছাড়া কেউ রাজপথে আওয়াজ তুলতে পারেনি। মাঠে আওয়াজ তোলার মতো কোনো কর্মসূচিও দেয়নি। বলা যায়, ঘোষণায় সীমাবদ্ধ দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম। এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে মাঠ গরম হলেও ভোটে অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মত দেখে গেছে। নতুন দলগুলোর মধ্যে এনসিপি কারো সঙ্গে জোটে না গিয়ে নিজেরাই দিতে চায় ৩০০ আসনে প্রার্থী। তবে, নবগঠিত অনেক দলই মতাদর্শের ভিত্তিতে জোট করতে আগ্রহী। কিছু দল নির্বাচনি জোট গড়তে চায় বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। নির্বাচনে অংশ নিতে এরই মধ্যে নতুন করে নিবন্ধন পেতে আবেদন পড়েছে নামসর্বস্ব ৬৫ রাজনৈতিক দলের। এদিকে, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের সময় দুই মাস বাড়িয়ে ২২ জুন করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচন ঘিরে তড়িঘড়ি করে প্রকাশ্যে আসা রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগই সুবিধার উদ্দেশ্যে মাঠে আসছে কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে।
নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চার বহিঃপ্রকাশ। তবে দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন দলগুলো জনপ্রত্যাশিত কণ্ঠের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কতটা এগিয়ে যাবে, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া দলগুলোর চর্চার ক্ষেত্র ও পরিবেশ কতটা ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন রকমের ভাবনা।
এসব রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ঘিরে তাদের কার্যক্রম প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনের যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে, বর্তমানে যে দলগুলো গঠিত হচ্ছে, সেখানে সঠিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হঠাৎ করে নির্বাচন সামনে রেখে গঠিত দলের বেশির ভাগ নেতা-ব্যক্তিকে দেশের বিশাল অংশ চেনে না বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। যারা দল গঠন করছেন, তাদের অনেকেই আবার নানা কাÐে বিতর্কিত। মূলত বিশেষ সুবিধা ও ক্ষমতার কাছাকাছি আসতেই তড়িঘড়ি করে গঠিত হচ্ছে অনেক রাজনৈতিক দল।
নির্বাচন যতই কাছে আসবে, দলগুলো জোট বাঁধবে। নির্বাচনের আগে দেশে দুটি বা তিনটি জোট থাকবে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে কোন জোট কত বড়। সেটা নতুন দলগুলোর জন্য সুযোগ এনে দেবে যেকোনো একটা জোটে ঢুকে পড়ার। একবার জোটে ঢুকলে জোটের থেকে অন্তত একটা সিটে মনোনয়ন চাওয়া খুবই যুক্তিসংগত। আর মনোনয়ন না পেলেও জোট জিতে গেলে অনেক সুযোগ-সুবিধা মিলবে।
এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ২২টি রাজনৈতিক দল ও চারটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। আসছে আরও নতুন রাজনৈতিক দল। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিলÑ এই আট মাসে গড়ে প্রতি মাসে তিনটি করে নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রবণতা পুরোনো অভ্যাসের ধারাবাহিকতা।
আলোচিত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), সমতা পার্টি, বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ’৭১, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), ভাসানী জনশক্তি পার্টি, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে তৈরি হচ্ছে ছাত্র সংগঠনও, যেমন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।
এ ছাড়া রয়েছে নিউক্লিয়াস পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আমজনতার দল, আ-আম জনতা, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ প্রভৃতি।
জোটে নেই এনসিপি: নির্বাচন বিষয়ে এনসিপির কোনো ঐক্য বা জোট গঠনে আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, এজেন্ডার ভিত্তিতে মাঠের ঐক্য বা রাজনৈতিক ঐক্য হতে পারে। তবে রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা আমাদের যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে এজেন্ডা, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, এখনই রাজনৈতিক জোট নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক দলে এসেছি, জনগণ নতুন যে গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, আমাদেরও হাঁটতে হবে। মৌলিক সংস্কার ও বিচার এখন আমাদের প্রধান দাবি। নির্বাচন নিয়ে আপাতত আমাদের কোনো রোডম্যাপ নেই। তা ছাড়া সংবিধান সংস্কার করতে হলে সেটা সংসদীয়ভাবে করা ঠিক হবে না। সংবিধানের পরিবর্তন কিংবা সংশোধন করতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই তা করতে হবে।
মতাদর্শ মিললে জোটে যেতে প্রস্তুত আ-আম জনতা: বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টির আহ্বায়ক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন বলেন, নিবন্ধন পেলে নির্বাচনে অংশ নেব। একই সঙ্গে নতুন দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে লড়াইয়ের বিষয়টা নির্ভর করবে সেই দলগুলোর আদর্শ-মতাদর্শের ওপর। এটা শুধু নতুন দল নয়, যেকোনো দলের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের যদি মিল থাকে, আমরা অবশ্যই জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে লড়ব। আমাদের নিবন্ধনের কার্যক্রম চলছে, খুব সম্ভবত এ মাসের মধ্যেই নিবন্ধনের কার্যক্রম সমাপ্ত করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
বড় দলের সঙ্গে জোট: আমজনতা দলের যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে আমরা এখনো তেমন কোনো তৎপরতা শুরু করিনি। তবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। শিগগিরই এ বিষয়ে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে আমাদের বিগত দিনের যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নষ্ট হয়নি। তাই বিএনপির সঙ্গে আমাদের যুগপৎ পথচলা ছিল, আছে, আগমীতেও এই পথচলা থাকবে।
উল্লেখ্য, দেশে নবগঠিত প্রায় সব দলই রাজনীতিতে পেশিশক্তির দাপট, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির বৃত্ত ভেঙে ফেলতে চায়। এ ছাড়া ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, ধর্মবিদ্বেষ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে তারা। বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক আজাদি এবং বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাবের কথা বলে দলগুলো গঠিত হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, কতটুকু জনগণের জন্য কাজ করে তারা।
আপনার মতামত লিখুন :