চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনে এক ধরনের গণঐক্য তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছাত্র-জনতার। গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ে এই ঐক্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
আন্দোলনে দল-মত-নির্বিশেষে দাবি ছিল, গত ১৬ বছর ধরে চলা গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, নির্বিচার জুলুম-নির্যাতনের বিচার। তবে আওয়ামী সরকারের পতনের ৯ মাস পর নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি মন্তব্যে সেই ঐক্যে বিভেদ এখন স্পষ্ট।
বিশেষ করে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দূরত্ব অনেক দিন ধরেই বাড়ছে। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার হার এতটাই প্রকট হয়ে উঠছে যে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপি ক্রমেই রাজনীতিতে একঘরে হয়ে পড়ছে!
তবে এনসিপি নেতাদের দাবি, বর্তমানে দেশে রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় সেই সুযোগ তৈরি করেছে। প্রত্যেকটি দল স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারছে। এতে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতের পার্থক্য দৃশ্যমান হলেও আদতে সেটি দূরত্বের বিষয় নয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মতপার্থক্যের বিষয়টিকেই রাজনৈতিক দূরত্ব বলে মনে করছেন।
দেশের বর্তমান রাজনীতির ঘটনা পরম্পরায় দেখা যাচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা নিয়ে প্রথম থেকেই বিএনপির সঙ্গে এনসিপির মতপার্থক্য ছিল। তবে দল দুটির মধ্যে কোন্দলের প্রথম আভাস পাওয়া যায় গত ২৩ জানুয়ারি।
এদিন দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শহিদ আসাদের ৫৬তম শাহাদাতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বেশ কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে নির্বাচনের সময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার হবে।
সেই বক্তব্য নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। পরে এ বিষয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দেন এনসিপি নেতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
তিনি লেখেন, বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। ১/১১-এর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ১/১১-এর সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।
নাহিদ ইসলাম ছাড়াও বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের দায়িত্ব নেওয়া নিয়ে দ্বিতীয়বার এনসিপির সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এতে দুই দলের নেতারাই পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করতে থাকেন। ইশরাকের অনুসারীরা ঢাকাবাসীকে নিয়ে টানা কয়েক দিন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন।
এরপর এনসিপি নেতাকর্মীরা অনেকটা পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট উল্লেখ করে কমিশন বাতিল ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে ইসি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে দলটি। এতে দূরত্বের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
এরপর গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দুজন ছাত্র উপদেষ্টার বিষয়ে প্রশ্ন তোলে। লিখিত বক্তব্যে বিএনপি বলে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা, যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।
পরে গত বুধবার নয়াপল্টনে ‘তারুণ্যের সমাবেশে’ বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সরকারের যেসব উপদেষ্টা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বোঝে; উপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতি ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় তাদের অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন।
বিএনপির অভিযোগ অনুযায়ী সরকারের ওই দুই ছাত্র উপদেষ্টা কোনো পদে না থাকলেও আগামীতে তারা এনসিপি থেকেই নির্বাচন করবেন বলে জনমনে চর্চা রয়েছে। এ ছাড়া উপদেষ্টাদের প্রসঙ্গে বিএনপির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের পাল্টা বক্তব্যও কিছুটা প্রমাণ করে এই দুই নেতা তাদের লোক।
এনসিপির সঙ্গে নাম জড়িয়ে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ করতে বলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা ইস্যুতে দলের অবস্থানকে কেন্দ্র করে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব তৈরির বিষয়টি সামনে আসে।
জানা গেছে, গত ১২ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনসিপি জানায়, ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করবে। এ ছাড়া নানা বিষয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয় এনসিপির। প্রকাশ্যে দুই পক্ষের নেতারাই রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিতে থাকেন।
বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির রাজনৈতিক দূরত্বের বিষয়টি এই তিন দলের নেতাদের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যেও পাওয়া যায়।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে ক্ষমতার পরিবর্তন কিংবা দেশে সুশাসন বা গণতন্ত্র ফিরে আসার সম্পর্ক নেই।
দেশে বিরাজমান সংকট নিরসনের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে হতে হবে। অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির কোনো দূরত্ব নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। বিএনপি ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির চিন্তা করে কথা বলে না। প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় এনসিপি।
অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, জুলাইয়ের গাদ্দারদের আহ্বানে নয়, বরং নিজ নিজ তাগিদে দেশের স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী কিছুটা কৌশলী ভূমিকা পালন করছে। সরাসরি রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে দেখা গেছে দলটির নেতাকর্মীদের।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দূরত্ব নেই জানিয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে ‘চব্বিশের অভ্যুত্থান’ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চায় এনসিপি। এসব ইস্যু নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোন্দল নেই। যা দেখছেন, এগুলো বড় দলগুলোর রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে ইতিহাসের সব কিছুকে স্বীকৃতি দিয়েই রাজনীতি করতে চায় এনসিপি। সংস্কার ও বিচার অসম্পূর্ণ রেখে আমরা নির্বাচনের দিকে যেতে পারি না। নির্বাচনের জন্যই সংস্কার ও বিচার প্রয়োজন।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব আরশাদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো চায় না নতুন দলগুলো উঠে আসুক। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো কন্টিনিউয়াসলি তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দিকে এগোচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বড় দলগুলো যদি পাওয়ারের জন্য হাংরি (ক্ষুধার্ত) হয়ে ওঠে এখনই, সেটা তো খুবই ভয়ংকর।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশে বিএনপি ও জামায়াতের বিশাল জনসমর্থন রয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির কোটি কোটি দলীয় সমর্থক থাকার পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক শ্রম ও ত্যাগ। এনসিপি নতুন রাজনৈতিক দল। বর্তমান পেক্ষাপটে তারা নিজেদের বিএনপির শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করবে, এটি স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের আলোচনায় রাখার কৌশল এনসিপির। সেই কৌশল থেকেই বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বাকযুদ্ধের অবতারণা হচ্ছে। তবে নির্বাচন যত দেরিতে হবে, নতুন দলগুলোর জন্য ভালো হবে। এ কারণে নির্বাচনের মতো ইস্যুতে এনসিপির সঙ্গে মতপার্থক্য নিয়ে দূরত্ব স্বাভাবিক।