এ যেন ২০১৯ সালের পুনরাবৃত্তি। একদিকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, অন্যদিকে করোনার সূচনা। বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনা যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখনো বাংলাদেশ এর ভয়াবহতা বুঝতে পারেনি। যা ২০২০ সালের মার্চে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করে।
লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশনের মতো কঠিন কঠিন শব্দ শিখতে গিয়ে এ সময় দাঁত ভাঙতে হয় অনেককে। পাঁচ বছর পর আবারও একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে দেশ। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাস সংক্রমণ। বাড়ছে মৃত্যুও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় করোনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য টিকা পৌঁছালেও এখনো অনেক হাসপাতালে তৈরি হয়নি ডেঙ্গু বা করোনার জন্য ডেডিকেটেড ওয়ার্ড। যদিও ডেঙ্গু সংক্রামক নয়, তবুও এর চিকিৎসার জন্য কয়েকটি হাসপাতালে এর আগের বছরগুলোতে ডেডিকেটেড ওয়ার্ড ছিল। যা চলতি বছর একেবারেই নেই। আর করোনার সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুতই বলা যায় হাসপাতালগুলোকে। এমন পরিস্থিতিতে আবারও আরেকটি মহামারির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য মতে, গতকাল শনিবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১৬৯ জন। এর মধ্যে বরিশালেই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১০১ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ওই নারীর বয়স ৩৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু ভাইরাসে মোট ২৯ জনের মৃত্যু হলো, যার মধ্যে গত এক সপ্তাহেই মারা গেছেন ছয়জন।
এ ছাড়া ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট পাঁচ হাজার ৭৩৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৭ জন সুস্থ হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে চট্টগ্রাম বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ জন। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৬, দক্ষিণ সিটিতে ১৯ এবং সিটি করপোরেশনের বাইরে ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচজন।
এদিকে গত শুক্রবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মারা গেছেন ২৮ জন। আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৭০ জন। অন্যদিকে হঠাৎ করেই ওমিক্রনের নতুন ধরন শনাক্তের কারণে সাম্প্রতিক কয়েক দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে গত শুক্রবার দুইজনের মৃত্যু হয়েছ। গতকাল নতুন করে আরও ৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। ১৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এদের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
এখনো করোনা চিকিৎসায় আলাদা কোনো ওয়ার্ড চালু করা হয়নি জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পরীক্ষার জন্য কিটের সমস্যা ছিল। মাঝখানে করোনা না থাকার কারণে কিটগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সবগুলো হাসপাতালেরই একই সমস্যা ছিল। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট এবং আরটিপিসি দুইভাবেই টেস্ট করার যন্ত্রপাতি আমাদের কাছে আছে।
আমাদের কলেজে আছে। কাজেই আমরা এখন টেস্ট করতে পারব। টেস্ট করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এখনো আলাদা কোনো ওয়ার্ড করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড কোনো ওয়ার্ড এখনো না হলেও আমরা একটি কর্নার নির্ধারণ করেছি।
দু-চারজন রোগী যদি হয় সেখানে রাখব। এরপর আমাদের পদক্ষেপ হচ্ছেÑ আমাদের একটি আইসোলেশন ওয়ার্ড আছে। সেখানে এখন অন্য রোগীরা থাকে। রোগী বাড়লে সেটি খালি করে শুধু করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া হবে। তবে আমাদের ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ডেডিকেডেট ওয়ার্ড আছে। তাদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া হচ্ছে।
একই রকম অবস্থা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও। হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করার জন্য কিট পৌঁছালেও এখনো আলাদা কোনো ওয়ার্ড বা ডেঙ্গুর জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড করা হয়নি জানিয়ে হাসপাতালের ডেপুটি পরিচালক নূরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এর আগে যখন করোর ঊর্ধ্বমুখী প্রকোপ ছিল দেশে, তখন আমাদের হাসপাতাল সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছে।
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তাই। এবার এখনো ডেঙ্গু রোগী কম থাকায় আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ড করা হয়নি। রোগী বাড়লে অবশ্যই করা হবে। প্রয়োজনে শয্যাও বাড়ানো হবে। আর করোনা যেহেতু সংক্রামক সেহেতু এর জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ড করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
অন্যান্য রোগীর চাপ বেশি থাকায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এখনই করোনার জন্য আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ড চালু করা হচ্ছে না জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, এখনো আমরা কোনো করোনায় আক্রান্ত রোগী পাইনি। আপনারা জানেন অন্যান্য রোগীদের চাপ ঢাকা মেডিকেলের পরেই আমাদের হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি। তাদের সেবা দিতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। তারপরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমরা করোনা পরীক্ষা করার জন্য টেস্ট কিট পেয়েছি।
কোনো রোগী এলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ডও চালু করব। ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ওয়ার্ড নেই কেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগী মাত্র বাড়তে শুরু করেছে। আমরা অন্যান্য বছরের মতোই ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত রয়েছি।
তবে একেবারেই নাজুক অবস্থা রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুরান ঢাকার একমাত্র ভরসাস্থল হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ এত বেশি থাকে যে, কোনটা করোনা বা কোনটা ডেঙ্গু অথবা কোনটা ইনফ্লুয়েঞ্জা, তা বোঝা মুশকিল উল্লেখ করে রাজধানীর শনির আখড়া থেকে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা সিফাত রহমান বলেন, এসেছিলাম জ¦র নিয়ে।
প্রথমে ডেঙ্গু পরীক্ষা করেছেন ডাক্তাররা। নেগেটিভ এসেছে। এখন করোনা পরীক্ষা করানোর কথা চিকিৎসকরা বলেছেন। কাল পর্যন্ত কিট ছিল না। আজ (গতকাল) নাকি কিট এসেছে। কিন্তু এখনো কেউ পরীক্ষা করেনি। অপেক্ষা করছি।
জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেও। হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদাভাবে ডেঙ্গু কর্নার থাকলেও করোনা রোগীদের জন্য নেই কোনো বিশেষ ব্যবস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটির একজন চিকিৎসক বলেন, করোনার যখন দেশব্যাপী ভয়াবহ সংক্রমণ ছিল, তখনো আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছি।
এখন যেহেতু কারিগরি সব প্রস্তুতি আমাদের নেই, সেহেতু এখনো পরীক্ষা শুরু হয়নি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে খুব শিগগিরই আমাদের সব ধরনের সেবা প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। আমরা সেই মোতাবেক প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তবে দেশের সবগুলো বড় হাসপাতালেই করোনা পরীক্ষার কিট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগী নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হালিমুর রশীদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঢাকার প্রায় সবগুলো বড় হাসপাতালের পাশাপাশি রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা, রংপুরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কিট পাঠানো হয়েছ। সিলেট মেডিকেল থেকে এখনো কেউ কিট নিতে আসেনি, তাই তাদের দেওয়া হয়নি। কাল-পরশু তারাও পেয়ে যাবে আশা করছি।
হঠাৎ করে এত কিট কোথা থেকে পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কিছু বেসরকারি কোম্পানির কাছে কয়েক লাখ কিট এখনো রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ওয়ান হেলথ কেয়ার, এবোর্টের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা কিভাবে এত দিন এগুলো সংরক্ষণ করল এবং এসব কিটের মেয়াদ রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়াদ আছে বলেই আমরা সেগুলো সরবরাহ করেছি। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমদানিও করা হবে।
এর আগে গত সোমবার আইসিডিডিআরবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে ওমিক্রনের দুটি নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি ও এক্সএফসির আবির্ভাব হয়েছে, যা সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এই বছরের এপ্রিলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রথম শনাক্ত হওয়া এই জেএন.১ গ্রুপের ভ্যারিয়েন্ট এখন বেশ কয়েকটি অঞ্চলে শনাক্ত করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এই বছরের মে মাসে কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে অবস্থিত আইসিডিডিআরবি’র হাসপাতালভিত্তিক ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স স্টাডি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট ৭ শতাংশ ছিল। আতঙ্কিত হওয়ার কারণ না থাকলেও আইসিডিডিআরবি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানানো হয়।
এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর আগের বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস ফের নতুন রূপে ফিরে আসছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশে বাড়তি সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা ডেঙ্গুটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। জানেন যে, ডেঙ্গুর সংক্রমণ ইতিমধ্যে ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড করার জন্য যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তখন করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ।
আমরা সংক্রমণের গতি পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এখন জনগণের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। জনসমাগমে যেন আমরা অবশ্যই মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আর জ¦র হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গু না করোনা নিশ্চিত না হয়ে তো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে রোগী আরও খারাপ হবে।
এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, আমরা ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত করোনার যে ভয়াবহতা দেখেছি এখন যদি আবার এমনটি হয় তাহলে সামাল দেওয়া মুশকিল। কারণ আমাদের সেই সময়কার সব সেটআপ তো আর এখন নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আর সেই স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ নেই। তাই পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে নিজের সচেতনতা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুইতে হবে। বিশেষ করে বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। একই কথা ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও। নিজের বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোথাও পানি জমানো না থাকে। তাহলেই এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে।