১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বিদেশে কর্মী পাঠায়, মূলত মধ্যপ্রাচ্যে (বিশেষ করে সৌদি আরব)। ওই বছর মাত্র ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী বিদেশে যান। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশে যেতে থাকেন। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৮২.৭৯?মিলিয়ন?মার্কিন ডলার।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে সামনে আসে। মূলত আশির দশক থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়তে থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৩ কোটি (৩০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা। বর্তমান বিনিময় হারে (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের (৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা) প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই রেমিট্যান্সের এই রেকর্ড দেখা যায়নি।
গত অর্থবছরজুড়েই অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল রেমিট্যান্স। বলা যায়, সংকটের এ সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বারবার তা স্বীকারও করেছেন; বলেছেন, প্রবাসীদের সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল কাতারের রাজধানী দোহায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা আজ যে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পেরেছি, তার মূলে আপনারা (প্রবাসীরা)। আপনারা সহযোগিতা না করলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না। আপনারা কখনো আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাববেন না।’
এর আগে জাপান সফরে একই কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। গত ৩১ মার্চ টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে ধ্বংসাবশেষ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে প্রবাসীরাই মূল ভ‚মিকা পালন করেছেন। এটাই সত্য যে কঠিন সময়ে দেশের যে টিকে থাকা, তা সম্ভব হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৮২.৭৯?মিলিয়ন?মার্কিন ডলার। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৫০?মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স একাধিক দফায় বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭৫০?মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় । ২০০০-২০০১ অর্থবছরে বিলিয়ন ডলারের ক্লাবে প্রবেশ করে দেশের রেমিট্যান্স আয়। ওই অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০০ সালের পর রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে ২০১০-২০২১ পর্যন্ত প্রায় ২০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস চলার সময়ে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড ছিল ২ হাজার ৪৭৮ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাই থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ওই মাস ছিল উত্তাল; দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক দিন ব্যাংক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। সে কারণে জুলাই মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা কমেছিল; এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ কোটি (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের তিন মাস অবশ্য ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছিল। আবার জুলাইয়ের পর থেকে প্রতি মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। আগস্টে এসেছিল ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার, নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার, ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার আসে। ২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। মার্
রেমিট্যান্সে কেন ইতিহাস গড়ল এ প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন বলেন, ‘মূলত হুন্ডি কমে যাওয়ার কারণেই রেমিট্যান্স বাড়ছে। নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে হুন্ডি কমে গেছে। এখন দেশে যে রেমিট্যান্স আসছে, তার পুরোটাই বৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে। টাকা-ডলার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরও বাজার স্বাভাবিক রয়েছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এটা সুখবর।’ নতুন অর্থবছরেও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘নানা সংকটের মধ্যে অর্থনীতির জন্য ভালো খবর এলো। এক লাফে রেমিট্যান্স ৩০ বিলিয়ন ছাড়ানো সত্যিই বিস্ময়কর। এক-দুই বছর আগে এটা কল্পনাও করতে পারেনি কেউ। এর আগে কোনো অর্থবছরে ২৫ বিলিয়নও আসেনি। রপ্তানি আয়ের গতিও ভালো। কিন্তু আমদানি ব্যয় মেটানোর পর রিজার্ভ বাড়ছিল না। এখন দাতা সংস্থাগুলোর বাজেট সহায়তার প্রায় পৌনে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণে বেশ কিছুদিন ধরে চাপের মধ্যে থাকা রিজার্ভও সন্তোষজনক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এটা অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো খবর।’
এদিকে সদ্যবিদায়ি অর্থবছরে দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ঢাকা বিভাগের প্রবাসীরা। আর সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে রংপুর বিভাগে।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
এতে বলা হয়, সদ্যবিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে ৩ হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫২৪ কোটি ৩২ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রামে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৮১৮ কেটি ৪৬ লাখ ডলার। আর প্রবাসীরা সিলেট বিভাগে ২৬৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, খুলনা বিভাগে ১৩২ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, রাজশাহী বিভাগে ১০১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, বরিশাল বিভাগে ৮৪ কোটি ১৫ লাখ ডলার, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬০ কোটি ৮২ লাখ ডলার ও রংপুর বিভাগে ৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
এদিকে, গত জুন মাসে দেশে এসেছে ২৮২ কোটি ১৩ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে এসেছে সর্বোচ্চ ১৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলার, সিলেট বিভাগে ২০ কোটি ১০ লাখ ডলার, খুলনা বিভাগে ৯ কোটি ৯২ লাখ ডলার, রাজশাহী বিভাগে ৭ কোটি ৬৬ লাখ ডলার, বরিশাল বিভাগে ৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪ কোটি ১৩ লাখ ডলার ও রংপুর বিভাগে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।