দেশীয় স্টার্টআপ খাতকে বড় সুখবর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশীয় স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের জন্য দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ পাওয়ার শর্ত সহজ করেছে দেশের ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ঋণ এবং ইক্যুইটি শেয়ারের বিনিময়ে সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে স্টার্টআপ খাতে অর্থায়নবিষয়ক মাস্টার সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি স্টার্টআপদের অর্থায়নে পৃথক একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগের কথাও বলা হয় এই সার্কুলারে।
গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ও বিশেষ কর্মসূচি বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তাফা স্বাক্ষরিত ওই সার্কুলার প্রকাশিত হয়। বিষয়টিকে বাংলাদেশের স্টার্টআপ খাতের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন দেশীয় প্রযুক্তি বিশ্লেষক এবং উদ্যোক্তারা।
ব্যাংকিং খাতের জন্য প্রথমবারের মতো স্টার্টআপকে এই সার্কুলারে সংজ্ঞায়িত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্তৃতিযোগ্য এবং নতুন ও উদ্ভাবনী পণ্য ও সেবা প্রদানে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগকে স্টার্টআপ বলা হয়েছে। স্টার্টআপ উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে এই সার্কুলার বলছে, উদ্যোগ হবে প্রযুক্তির সন্নিবেশে অথবা মেধাস্বত্ব ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন পণ্য বা সেবা বা প্রক্রিয়া উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক চাহিদা পূরণে রাখা, সম্ভাবনাময় ও দ্রুত বিস্তৃতিযোগ্য (স্কেলেবল) হওয়া, বৈপ্লবিক পরিবর্তনে সক্ষম (ডিসরাপটিভ ইনোভেশন) উদ্ভাবন হওয়া এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবসায়িক উদ্যোগের বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত নেওয়ার সক্ষমতা থাকা। তবে স্টার্টআপদের জন্য সব থেকে আশাব্যঞ্জক সুখবর রয়েছে সার্কুলারে অর্থায়ন অংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন পেতে স্টার্টআপদের জন্য দুইটি সুযোগ রেখেছে। প্রথম সুযোগে, তফসিলি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে অর্থ নিয়ে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে ঋণ আকারে বিনিয়োগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার তহবিল থেকে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ (০.৫%) হারে ঋণ দেওয়া হবে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে। তফসিলি ব্যাংক সেই অর্থ সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ হারে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ আকারে বিনিয়োগ করতে পারবে।
দ্বিতীয় সুযোগে, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইক্যুইটি শেয়ারের বিনিময়ে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগের কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তফসিলি ব্যাংকগুলো প্রতি অর্থবছরের মুনাফার ১ শতাংশ অর্থ সেই প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা করবে। দুই উপায়েই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বনিম্ন ২ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে।
বিনিয়োগ প্রাপ্তির পরিমাণ
সার্কুলার বিশ্লেষণে দেখা যায়, উভয় ক্ষেত্রেই দেশীয় স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে তিনটি করে ধাপে বিনিয়োগ করা যাবে। প্রতিষ্ঠানের বয়স ২ বছরের কম হলে প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাবে। প্রতিষ্ঠানের বয়স ২-৬ বছরের মধ্যে হলে সেটি মধ্যম পর্যায়ে বিবেচিত হবে। আর সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যাবে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠানের বয়স ৬-১২ বছরের মধ্যে হলে সেটি বৃহৎ পর্যায়ে বিবেচিত হবে এবং সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাবে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান থেকেও সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ইক্যুইটি বিনিয়োগ করা যাবে স্টার্টআপে।
এক্ষেত্রে কোনো সম্ভাবনাময় উদ্যোগ এবং গ্রাহক চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন স্টার্টআপকে প্রাথমিক পর্যায় বা ‘সিড স্টেজ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত গ্রাহক এবং কার্যক্রম শুরুর পরে বিগত সময়ে আয়ে সক্ষম এমন স্টার্টআপ হবে প্রবৃদ্ধি পর্যায় বা ‘গ্রোথ স্টেজ’। আর সবশেষে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন স্টার্টআপকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও বিস্তৃতিযোগ্য বা ‘হাই গ্রোথ অ্যান্ড স্কেলেবল স্টেজ’ বলা হচ্ছে। তিনটি পর্যায়ে যথাক্রমে ২-৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ইক্যুইটি বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থ প্রাপ্তির যোগ্যতা
সার্কুলারে অর্থায়ন প্রাপ্তিতে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান এবং এর উদ্যোক্তাদের যোগ্যতারও কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্টার্টআপ বাংলাদেশে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হওয়া, উদ্যোক্তাদের বয়স সর্বনিম্ন ২১ বছর হওয়া, প্রতিষ্ঠানের বয়স সর্বোচ্চ ১২ বছরের বেশি না হওয়া, কোনো উদ্যোক্তা ঋণখেলাপি হলে অর্থায়নে অযোগ্য হওয়া অন্যতম। বাংলাদেশে কার্যক্রম থাকা কোনো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত স্টার্টআপ বাছাই প্রোগ্রামে আগে থেকে মনোনীত বা পুরস্কৃত স্টার্টআপ অর্থায়ন প্রাপ্তিতে এগিয়ে থাকবে।
অংশীজনদের সাধুবাদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশীয় স্টার্টআপ উদ্যোক্তা এবং প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ‘এই সার্কুলারের মাধ্যমে স্টার্টআপ পেশাজীবীদের দীর্ঘদিনের এক প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডি জবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুফ ইনফোটেককে বলেন, ব্যাংকের থেকে অর্থায়ন প্রাপ্তির আগের সীমা ছিল মাত্র ১ কোটি টাকা। এই অর্থ পেতে স্টার্টআপদের যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হতো, সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এত পরিশ্রম করে এত অল্প টাকা নেওয়ায় উদ্যোক্তারা আগ্রহ পাচ্ছিলেন না। তবে এখন সেই অবস্থার উন্নতি হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ হলো। বিষয়টি দেশের স্টার্টআপ খাতের প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’
স্টার্টআপ অর্থায়ন সার্কুলার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এসএমইএসপিডি) নওশাদ মোস্তাফা বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ সুবিধার পাশাপাশি ইক্যুইটি বিনিয়োগ সুবিধা প্রবর্তনসহ এই সার্কুলারে উল্লেখিত অন্যান্য সুবিধাগুলো চালুর জন্যে দেশীয় স্টার্টআপ খাতের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এর মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো স্টার্টআপকে সংজ্ঞায়িত করল এবং স্টার্টআপসমূহের বৈশিষ্ট্যগুলো নির্দিষ্ট করল।
একই সঙ্গে, ঋণ এবং ইক্যুইটি বিনিয়োগ পেতে স্টার্টআপদের পথ আরও সহজ হলো। স্টার্টআপ খাতে অর্থায়নের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে পুনঃঅর্থায়নের সুবিধাও ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে চালু করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা যে, স্টার্টআপে বিনিয়োগে তফসিলি ব্যাংকগুলো আরও এগিয়ে আসবে। পাশাপাশি স্টার্টআপ খাত এসব বিনিয়োগে উৎসাহ পাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অধিকতর ভূমিকা রাখবে।’