ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ চায় বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে শুরু থেকেই সংশয় রয়েছে।
এদিকে নির্বাচনের যথার্থ পরিবেশ নিশ্চিতে বর্তমান আইনশৃঙ্খলার দুর্বল পরিস্থিতি তুলে ধরে জুলাই সনদ ও মৌলিক সংস্কারসহ বেশ কিছু বিষয়ে এনসিপি এবং জামায়াত নেতারা একই সুরে কথা বলছেন। উভয় দলই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে রয়েছে সহাবস্থানে। দুই দলের অবস্থানকে সমর্থন দিচ্ছে ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু মনে করেন, কায়দা-কৌশল করে সংস্কারের নামে, বিচারসহ নানা বিষয় সামনে এনে নির্বাচনটাকে কীভাবে ঠেকানো যায় সেটি করা হচ্ছে। এদিকে, বিএনপি ২৬ সালের রোজার আগে ভোটের দাবিতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুররহমান বলেছেন, এমন অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনাও করা যায় না।
এমন অবস্থায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় দেখছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। তবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের বিষয়ে তৎপর রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছিলেন, সেখানে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে এসেছে। পরবর্তী সময়ে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে একমত হওয়ার কথা জানায় বিএনপি।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা সরকারকে অনুরোধ করব ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে বা মাঝে হোক, নির্বাচনের একটি তারিখ ঘোষণা করতে। নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা হলে এখন যে সংকট তা অনেকাংশে কেটে যাবে। আমরা মনে করি, নির্বাচনটা খুব জরুরি। নির্বাচন হলে কারা দুইটা না তিনটা সিট পাবে, জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, সেটা নির্বাচন ছাড়া তো বোঝা যাবে না। কায়দা-কৌশল করে সংস্কারের নামে, বিচারসহ নানা বিষয় সামনে এনে নির্বাচনটাকে কীভাবে ঠেকানো যায় সেটি করা হচ্ছে।
নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার ডিসেম্বর থেকে জুনের সময়সীমাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এ সময়সীমার যেকোনো মাসে নির্বাচন নিয়ে আপত্তি নেই দলটির। তবে দলটির অবস্থান এরপরেও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এ সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্টভাবে এপ্রিল মাস আবার কখনো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছে জামায়াত। জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, যেখানে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানা থেকে বিএনপি কর্মী ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে, এমন অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনাও করা যায় না।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, অবস্থানের কোনো পরিবর্তন নেই। জামায়াত প্রথম থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে যে বক্তব্য দিয়ে এসেছে, সেখানে ধারাবাহিকতা আছে। আমরা বিপরীতমুখী নই, বরং একই রকম বক্তব্য দিয়ে এসেছি। ডিসেম্বর থেকে জুনের কথা সমর্থন করলেও পরে আমরা বলেছি, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে নির্বাচন হতে হবে।
নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ভোটের সমতলভূমি নিশ্চিতসহ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচন যদি এপ্রিলে করতে হয় বা ফেব্রুয়ারিতে করতে হয়, তাহলে আর ছয়-সাত মাস সময় আছে। এর মধ্যে ভোটার তালিকা আপডেট হয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। সেটা এখনো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এখন প্রশাসনে যে সেটিংটা আছে, অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ইউএনও ইত্যাদি এখানে আমরা বলেছি নিরপেক্ষ লোকদের বসাতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সেটা নিশ্চিত করতে হবে বিফোর ডিক্লেয়ারিং দ্য ইলেকশন। কিন্তু এটার জন্য রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে যে বসা দরকার ছিল, সেগুলো হচ্ছে না। প্রশাসন তো বটেই, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটি এনসিপির নেতারা বলছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ও মৌলিক সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসাইন বলেন, শুধু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে নাÑ এমন কথা কিন্তু কেউ বলেনি। বরং সবাই বলেছে নির্বাচন হতে হবে এবং সেটা কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়ে তারপর হতে হবে, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন হওয়ার পর হতে হবে।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরাও নির্বাচন চাই। তবে বিচার, সংস্কারসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দাবির প্যাকেজ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন চাই না। প্রয়োজনে এসব দাবি বাস্তবায়নে আরেকবার গণঅভ্যুত্থান ঘটানো হবে। যারা এর বিরোধিতা করবে, তাদের লাল কার্ড দেখানো হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এখন যদি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বা অন্য দলের প্রস্তাবে অযৌক্তিকভাবে শতভাগ একমত হতে বলা হয়, এমনকি অযৌক্তিকভাবে যেখানে সরকারের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ক্ষুণœ হবে রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেখানেও যদি সবাইকে নিঃশর্ত রাজি হতে বলেন সেটা তো সংস্কার হলো না।
এদিকে, অধিকাংশ সময় জাতীয় নির্বাচনের অন্তত দেড় বছর আগে রোডম্যাপ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বিগত নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টা মতামত দিলেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো রোডম্যাপ দেয়নি নির্বাচন কমিশন। তবে সরকারের ঘোষণা অনুয়ায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন।
আপনার মতামত লিখুন :