বাংলাদেশের ওপর শুল্ক কমানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সাথে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন। তবে বৈঠকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক থাকবে কি না বা কমানো হবে কি না তা নিশ্চিত করে সরকার-ব্যবসায়ী কোনো পক্ষই বলতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা সরকারকে আশ^^স্ত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ হলেও ব্যবসায় চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা তাদের রয়েছে।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের আগে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের নিয়ে বৈঠক করেন। শুল্ক আলোচনার দ্বিতীয় দফার শেষ দিন ছিল গত ১১ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এ আলোচনা হয়।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রায় প্রতিটি প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন অথবা উত্তর দেওয়া যাবে না বলে বলেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, এটি একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট। তাই এ-সংক্রান্ত কোনো কিছু প্রকাশ করা যাবে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কি চেয়েছে বা কি আলোচনা হয়েছে তার বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। আর প্রকাশ করলে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি হবে। আশা করি যা আপনারা কেউ চান না।
উল্লেখ্য, নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট যা গোপনীয়তা চুক্তি বা গোপনীয় তথ্য চুক্তি নামেও পরিচিত। একটি আইনি চুক্তি যা দুটি পক্ষের মধ্যে গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদান এবং সুরক্ষার জন্য করা হয়। এই চুক্তিতে একটি পক্ষ (প্রকাশক পক্ষ) অন্য পক্ষের (গ্রহীতা পক্ষ) সাথে কিছু গোপন তথ্য শেয়ার করে এবং গ্রহীতা পক্ষ সেই তথ্য প্রকাশ না করার জন্য সম্মত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সফর বিষয়ে বশির উদ্দিন বলেছেন, রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পারস্পরিক বা পাল্টা শুল্ক) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই পর্যায়ের আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, যুক্তরাষ্ট্র যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে বলেও তিনি আশা করে বলেন, আমাদের আলোচনা উৎসাহব্যঞ্জক এবং যথেষ্ঠ এনগেজিং ছিল।
তিনি বলেন, তিন দিন খুবই এনগেজ সময় কাটিয়েছি। দুই দেশের শুল্ক সমঝোতায় প্রায় ৩৫-৪০ জন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সুন্দর সুন্দর কিছু পরামর্শ আমরা পেয়েছি সেখানে। সেগুলো আমরা কাজে লাগাব।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌক্তিক শুল্কহারের কথা বলা হচ্ছে, আসলে কত শতাংশ শুল্ককে যৌক্তিক মনে করছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘শূন্য’।
পহেলা আগস্ট থেকে পাল্টা শুল্ক পুনঃআরোপিত নাকি নতুন শুল্কহার পাওয়া যাবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ করবে। কারণ আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা করছে। ২০১৫ সাল থেকে শুল্ক-কর পরিশোধ করেই সেটা করছি। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সক্ষমতার ভিত্তিতে এ ব্যবসা করছে এবং তুলনামূলকভাবে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈষম্যের শুল্ক না হলে আমরা সেটা করে যাব।
চীনের সঙ্গে ব্যবসা নিরুৎসাহিত করতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো শর্ত দিচ্ছে কি নাÑ সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উপদেষ্টা কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট নিয়ে কোনো প্রশ্নে জবাব এখন দেব না। তবে আমাদের যেন একটা ভালো আউটকাম আসে সেজন্য সবাই মিলে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, তিন দিনের দ্বিতীয় রাউন্ডের বৈঠক শেষে আমরা এখন তৃতীয় রাউন্ডের বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি নিতে ফিরে এসেছি। দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে আজ (সোমবার) বৈঠক করেছি। এছাড়া কিছু আন্তঃমন্ত্রণালয়ে আলোচনার বিষয় রয়েছে। সেগুলো শেষ করে আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি আবারও আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাব।
এ সময় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ইস্যুতে ব্যবসায়ীদের নানা হতাশার কথা এতদিন বলা হয়েছেÑ সাংবাদিকদের এমন মন্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এটা পূর্বের হতাশা। এখন কোনো হতাশা নেই।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। আমরা সেখান থেকে বেশকিছু পরামর্শ পেয়েছি। অবশ্য এ পরামর্শগুলো আমরা আমাদের মধ্যেই নির্দিষ্ট রাখব। আমরা আশা করছি এই আলোচনার মাধ্যমে আমাদের জন্য একটি যৌক্তিক শুল্কহার নির্ধারণ করবে রপ্তানির ওপরে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, পাল্টা শুল্ক বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের অভিঘাত। সেজন্য সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও কাজ করছে। ইতোমধ্যে কিছু কাজ করা হয়েছে, আরও কিছু কাজ করতে হবে। এখন আমরা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তাদের মতামত নিলাম। আমাদের প্রস্তুতি আছে। সামনে যেকোনো বিষয়ে আসলে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেটি নিয়ে আমরা আলোচনা করব। আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় থাকতে পারে। কারণ শুল্কের বিষয়টিই যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হিসেবে নিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ আলোচনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে যে আলোচনা হয়েছে সেটি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যা অবহিত করা হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে চুক্তিটি যেহেতু একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট তাই এই বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না।
তিনি বলেন, এই চুক্তির আওতায় আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে কি সুবিধা দিব বা যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কি সুবিধা দিবে তা, এমনকি কি কি পণ্যে বাংলাদেশ ছাড় দিবে তাও প্রকাশ করা ঠিক হবে না। কারণ এসব প্রকাশ করলে চুক্তি বিষয়ে আর অগ্রগতি হবে না।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের মতামত জানতে চেয়েছে, তবে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট হওয়ায় এই বিষয়ে আমাদের কিছু বলা হয়নি। তবে সরকার পক্ষ যে ভাষায় কথা বলেছে তাতে মনে হয়েছে তারা ইতিবাচক দিকেই এগিয়েছে। ফলে আমরা আশা করতেই পারি ভালো কিছু হবে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের ডেকেছে। আমরা তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়েছি কিন্তু সরকার পক্ষ থেকে আমাদের কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি। আপনাদের প্রশ্নে যেভাবে বলা হয়েছে বলা যাবে না, আমাদেরও তেমনি বলা হয়েছে, বলা যাবে না।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপরে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র এ শুল্ক আরোপ করার পরে বিশ্ববাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে ৭ এপ্রিল এই শুল্ক ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করে।
এই অবস্থায় গত ৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো এক চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছেন। নতুন এ শুল্ক হার ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে। বাংলাদেশও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করার চেষ্টা করছে। সেজন্যই বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরÑ ইউএসটিআর’র সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। যদিও ওইসব বৈঠকে সব বিষয়ে একমত হতে পারেনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র।
বৈঠকে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু, বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজদের সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ, এপেক্স ফুটওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ, র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান, এফবিসিসিআই’র প্রশাসক হাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।