ঢাকা সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক

দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে মতবিরোধ

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০২৫, ০৩:০০ এএম

সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন করার ব্যবস্থা বাতিল করে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে (তত্ত্বাবধায়ক) যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে অধিকাংশ দল। তবে দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে দলগুলোর মধ্যে। এ ছাড়া চলতি জুলাই মাসের মধ্যেই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার বিষয়েও জানানো হয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে। 

গতকাল রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ১৫তম দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিমধ্যেই জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ করছে। আজ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইতিমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। আশা করছি বাকি দিনগুলোর সংলাপে আরও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। সব রাজনৈতিক দলই এ ব্যাপারে একমতÑ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের তিন উপ-অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে। সংশোধিত ভাষ্য হবেÑ ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধান, যা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ, সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন করার যে ব্যবস্থা ছিল, সেটা বাতিল করে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আমরা সেখানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছি।

অধিকাংশ সময় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান অর্থাৎ, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন রকম প্রস্তাব ছিল। আমরা সর্বশেষ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব চেয়েছিলাম। সে অনুযায়ী চারটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আমরা প্রস্তাব পেয়েছি। তারা হলোÑ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী।

তিনি আরও বলেন, চার দলের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কমিশন সকালে একটি সংশোধিত প্রস্তাব হাজির করে। এই প্রস্তাবের একটি লিখিত ভাষ্য তৈরি করা হয়েছে এবং বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ওই লিখিত প্রস্তাব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কাছে দেওয়া হয়েছে। তারা ওই খসড়া প্রস্তাব নিয়ে দলগতভাবে আলোচনা করে আগামীকাল আমাদের মতামত জানাবেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করছি পরশু এ বিষয়ে কমিশনের অবস্থান বা একমত হওয়ার জায়গাটা বলতে পারব।

আলী রীয়াজ বলেন, উচ্চকক্ষের বিষয়ে একাধিক দিন আলোচনা হয়েছে। উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কোনো ভিন্নমত নেই। তবে কীভাবে হবে, সে বিষয়ে দুটি মত আছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর এই মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা কমিশনের কাছে এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে। কমিশন ইতিমধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা করেছে।

এদিকে দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানের কথা জানায় বেশ কয়েকটি দল। যেমনÑ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল এক ব্যক্তিকে একাধিক পদে থাকার বিষয়ে আপত্তি জানায়। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানালেও প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একজন হওয়ার পক্ষে মত জানায় জামায়াতে ইসলামী।

এদিকে দলের প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রাখা উচিত বলে মনে করে বিএনপি। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পৃথিবীর গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে আমরা যুক্তরাজ্যের উদাহারণ দিয়ে থাকি। সেখানেও দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হয়ে থাকেন। তবে কয়েকটি দেশে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। সেটিও সরকারি দল সিদ্ধান্ত নেয় কে প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাই দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রাখা উচিত হবে বলে মনে করে বিএনপি। আশা করি, পরবর্তী আলোচনায় আমরা একমত হতে পারব।

বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনীতে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, তাতে কিছু পরিবর্তন আনা যায় কি না, তা নিয়ে আজ আলোচনা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হাতে পেয়েছি। এটা দেখে পর্যালোচনা করে মতামত দেবে বিএনপি।’

ঐকমত্য কমিশনের নতুন খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার আলোচনা হবে বলে জানান বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আজ মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।’

একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদনেতা (লিডার অব দ্য হাউস) হওয়ায় দেশে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে নাÑ এমন মন্তব্য করে এই প্রথার অবসান চান জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এক ব্যক্তি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করে থাকেন। এতে দলীয় আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামোতেও প্রভাব ফেলে এবং দলীয় আনুগত্য বিচার বিভাগসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানেও প্রবেশ করে।

আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি নিয়েও বিস্তারিত মত দেন নাগরিক পার্টির এই নেতা। তিনি বলেন, আমরা প্রায় দুই মাস আগেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি রূপরেখা জমা দিয়েছিলাম। সেখানে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বাছাইয়ের জন্য একটি ৫-৭ সদস্য বা ১১ সদস্যের কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি সরকারি দল, বিরোধী দল এবং সংসদে তৃতীয় অবস্থানে থাকা দলের কাছ থেকে নাম সংগ্রহ করবে।

তিনি জানান, পরবর্তী সময়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও অনুরূপ প্রস্তাব দেয় এবং ঐকমত্য কমিশন চার দলের প্রস্তাব মিলিয়ে একটি সম্মিলিত খসড়া প্রণয়ন করেছে।

প্রস্তাবিত খসড়া অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি মিলে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠিত হবে। সরকার ও বিরোধী দল তিনজন করে এবং তৃতীয় দল দুজনের নাম প্রস্তাব করবে। এই আটজনের মধ্য থেকে র‌্যাংকড চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা চূড়ান্ত করা হবে।