‘আমার ছেলে উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ে। সোমবার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আল্লাহর রহমতে আমার ছেলের কোনো ক্ষতি হয়নি। ছেলে এখানে পড়ালেখা করলেও আমার তেমন আসা হয় না। তবে বিধ্বস্তের ঘটনার পর নিজ চোখে প্রতিষ্ঠানটি দেখতে এসেছি কিন্তু স্কুলের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে প্রবেশ করতে না দিলেও অন্তত অভিভাবকদের প্রবেশ করতে দিত। তারা কেন সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না সেটা আমাদের জানা দরকার।’ গতকাল বুধবার এমনটাই অভিযোগ করেন মো. হোসেন মিয়া নামের ওই অভিভাবক।
তবে ঘটনাস্থলে একাধিক অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের পর তিন দিন পার হলেও ট্রমা বা আতঙ্ক কাটেনি অনেকেরই। বিশেষ করে যারা ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল, তাদের মধ্যে এই ট্রমা কাটতে সময় লাগবে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি ছিল আকস্মিক এবং ভয়াবহ, যা অনেকের মনে গভীর দাগ কেটে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারী এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক সাইফুল ইসলাম জানান, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর শিক্ষার্থীসহ সবার মধ্যে আতঙ্ক, ভয় ও শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অনেকেই তাদের প্রিয়জনদের হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ ঘটনার আকস্মিকতা এবং ভয়াবহতার কারণে অনেকের মধ্যে মানসিক আঘাত সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যারা ঘটনার সময় কাছাকাছি ছিল, তাদের মধ্যে ট্রমা বা মানসিক আঘাতও উদ্বেগের। তিনি বলেন, স্কুলের প্রধান ফটক বন্ধ। দর্শনার্থী, সাংবাদিক কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। স্কুলের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
ঘটনাস্থলে কথা হয় আরেক অভিভাবক সেলিমের সঙ্গে। তিনি আলাপকালে বলেন, বিমান বিধ্বস্তের সময় অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে ছিলাম। গত রাতেই ঢাকায় ফিরেছি। তাই এখন স্কুলটা দেখতে আসলাম, কিন্তু স্কুলের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। হোসেন, আমির ও সেলিমের মতো অসংখ্য অভিভাবক মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রবেশ করতে বাধার সম্মুখে পড়েছেন। শুধু অভিভাবকেরা নয়, সাংবাদিকরাও প্রবেশের বাধার মধ্যে পড়েছে।
একাধিক সাংবাদিকদের অভিযোগ, পেশাদার কাজে বাধা সৃষ্টি করছে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ। যদিও মাইলস্টোন গ্রুপের পরিচালক রাসেল তালুকদার জানিয়েছেন, ‘এসব প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমরা এখনো তেমন কিছু জানি না।’ তবে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভালো বলতে পারবেন।’
তবে ঘটনাস্থলে কথা হয় একাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে। তারা জানান, মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ প্রবেশের যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, এটার কারণ হতে পারে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়া। যেটা বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর, স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে তারা হয়তো প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। তাদের দাবি, অবিলম্বের সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চান তারা।
ঘটনার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে কৌতূহলী মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেলেও তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় বাসিন্দারাও ছিলেন। অনেককেই গেটের ফাঁক দিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের ছবি তুলতে ও ভিডিও ধারণ করতে দেখা গেছে। 
ঘটনাস্থলে কথা হয় দায়িত্বরত তুরাগ থানার কমিউনিটি পুলিশ সদস্য মো. রফিকের সঙ্গে। তিনি জানান, আমাদের বলা হয়েছে অভিভাবক, সাংবাদিকসহ উৎসুক জনতা কেউ আপাতত ভেতরে ঢুকতে পারবে না। সবাই বাইরে অপেক্ষা করবে। ফটকের সামনে দায়িত্বে থাকা কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর থেকেই মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সাংবাদিক ও কৌতূহলী দর্শনার্থীদের প্রবেশ নেই বললেই চলে। তবে স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বিঘেœ ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। গতকাল বুধবার সকাল থেকে এই বিধিনিষেধ জারি করে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ।
দেখা যায়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকের ভেতর থেকে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ফটকের ভেতরে নিরাপত্তাকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশের কয়েকজন সদস্যও সেখানে বসে আছেন। বাইরে গণমাধ্যমকর্মী এবং অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে আশপাশের এলাকায় উৎসুক জনতাও দেখা গেছে। তাদের কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কেন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তার জবাবে নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের নিষেধ করেছেন।
আতঙ্কিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা
বিমান দুর্ঘটনার সময় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে বিমানটি ভেঙে পড়লে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলের অভিভাবকরাও খবর পেয়ে ছুটে আসেন সন্তানদের খোঁজ নিতে। অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এদিকে, তাৎক্ষণিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুর্ঘটনার একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। 
এদিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় ট্রমার মধ্যে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে রাজধানীর স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে উদ্বিগ্ন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আশ^স্ত করার মতো কোনো পদক্ষেপ এখনো নিতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসন। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম পাওয়া যায়। বেশির ভাগ স্কুলে পরীক্ষা চলছে। এজন্য অভিভাবকরা উদ্বেগের মধ্যে থেকেও সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। অনেক অভিভাবক স্কুলভ্যান বা গাড়িতে শিক্ষার্থীদের পাঠালেও গত কয়েকদিন বিষয়টি ছিল ব্যতিক্রম। অনেক অভিভাবক নিজেরাই সন্তানদের স্কুলে নিয়ে গেছেন, আবার নিয়ে এসেছেন। এসব বিষয়ে কথা হলে একাধিক অভিভাবকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চোখ এখন শিক্ষার্থীদেরও। তারা মাইলস্টোন স্কুলের বিভিন্ন মর্মান্তিক ছবি দেখে ট্রমার মধ্যে চলে যাচ্ছে। এ ঘটনা নিয়ে তারা মা-বাবাকে বারবার নানা প্রশ্ন করছে। অভিভাবকরা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন। অনেকে বাকরুদ্ধ হয়ে নীরবে অশ্রু ফেলছেন।
রাজধানীর শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক রাসেল পারভেজ জানান, ‘আমরা খুবই আতঙ্কিত! মাইলস্টোনের ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারত। স্কুল বাচ্চার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আমার সন্তান যে পাঁচ ঘণ্টা স্কুলে থাকবে, সেই পুরোটা সময়ই দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকব। সরকারের আগে উচিত হবে স্কুলকে নিরাপদের জন্য যা যা করা দরকার তা করা। এখন চিন্তা করছি, আপাতত চলতি সপ্তাহ ছেলেকে স্কুলে পাঠাব না।’ মাইলস্টোনে পড়ুয়া এক ছাত্রের অভিভাবক পলাশ আহম্মেদ বলেন, এই ঘটনার পর চিন্তা করছি আর ভাবছি, রাতে আমরা কেউ ঘুমাতে পারি না। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করে রাজধানীর একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমরা নিজেরাও কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা ইচ্ছা করলেই স্কুল বন্ধ করতে পারি না। এ অবস্থায় উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি অধিদপ্তরের। গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ছিল। শিক্ষার্থীরা ট্রমার মধ্যে। এ অবস্থায় মাউশি নির্দেশনার মাধ্যমে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে পারত। পরীক্ষা থাকলেও তা পরে নিলে তেমন সমস্যা হতো না। শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও ট্রমা কাটাতে পারত।’
সূত্র মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে স্কুল চলাকালে এ ধরনের দুর্ঘটনা এটাই প্রথম। একই সঙ্গে স্কুলে এমন বিপুলসংখ্যক হতাহত আগে কখনো ঘটেনি। এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার সারা দেশ যখন শোকে স্তব্ধ, তখন অনেকটাই ঘুমিয়ে ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। অথচ এ সময় সারা দেশের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের জন্য তাদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা ছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি অধিদপ্তরে অদক্ষ কর্মকর্তারা ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। তারা শুধু ব্যক্তিগত সুবিধা নিতেই ব্যস্ত। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জুবাইরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরারের পদত্যাগের দাবিতেও বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খানের নেতৃত্ব নিয়েও বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজ গায়েবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সন্দেহ
এদিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর পরই কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছিল, যা থেকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। তবে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মধ্যে যেসব সিসিটিভি ফুটেজ ছিল সেগুলো গায়েব হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর, স্কুল কর্তৃপক্ষের এমন দাবি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না এমন কথাবার্তা কেন আসবে। যেটা সত্যি সেটা সামনে আসলে সমস্যা কী?

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                    -20251030020737.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                            -20251030233957.webp) 
        
        
        
       -20251030225605.webp) 
        
        
       -30-10-25-20251030222222.webp) 
        
        
        
        
        
       -20251030213733.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন