শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোমলমতিরা। একনজর দেখতে কাচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছেন স্বজনেরা। প্রিয় সন্তানের এমন করুণ পরিণতিতে মায়েদের শাড়ির আঁচল ভিজছে চোখের জলে। সময় যত গড়াচ্ছে, স্বজনদের মধ্যে ততই বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বাড়ছে প্রিয়জনকে চিরতরে হারানোর শঙ্কা। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন কেউ কেউবা অধিক শোকে পাথর। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউ, এফএইচডিইউ ও সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সামনে স্বজনদের বুকফাঁটা আহাজারি থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অন্তত যেন প্রাণে বেঁচে থাকে আদরের সন্তান এই একটা প্রার্থনাই সবার। কোনো প্রয়োজনে ডাক্তার কিংবা নার্স খুঁজলেই আতঙ্কে আঁতকে উঠছেন স্বজনরা।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে পড়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে গতকাল বুধবার রাতে এ খবর লেখা পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ৯ বছরের শিশু নাফি। তার শরীরের ৯৫ শতাংশই দগ্ধ হয়েছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এর এক দিন আগেই সোমবার রাত ৩টার দিকে মারা যায় তার বড় বোন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজিয়া।
এদিকে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে আগুনে পুড়ে অঙ্গার ছয় লাশের পরিচয় শনাক্তে এখন পর্যন্ত ১১ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল বুধবার সকাল থেকে নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়। তবে তাদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। এ ছাড়া যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত শিশুদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৪৪ জনের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। ১৩ জনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে বার্ন ইনস্টিটিউটে ঘুরে দেখা যায়, চিকিৎসাধীন শিশুদের স্বজনরা কখনো বারান্দায় আবার কখনো বা ফ্লোরে বসে কাঁদছেন। কেউবা কাচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দগ্ধ প্রিয় মানুষটি কেমন আছেন একনজর দেখার চেষ্টা করছেন। চোখের পানিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের সুস্থতার জন্য দোয়া করছেন। অনেক স্বজন ওয়ার্ড থেকে আইসিইউতে ছোটাছুটি করছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালের ভেতরে ঢোকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু দগ্ধ শিশুদের সুচিকিৎসায় যাতে কোনো ধরনের ইনফেকশন না ছড়ায়, সেজন্য স্বজনদের প্রবেশ সীমিত করে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে অচেতন গুরুতর দগ্ধ সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহতাব রহমান ভূঁইয়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে অসহায় বাবা মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া। তার চোখ অশ্রুসিক্ত; হৃদয়ে একমাত্র সন্তানকে সুস্থভাবে ফিরে পাওয়ার আকুতি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাহতাবের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি। অবস্থা খুবই সংকটজনক। মিনহাজুর রহমান বলেন, ডাক্তাররা জানিয়েছে ওর অবস্থা খুব খারাপ। আমি আল্লাহর কাছে, দেশের মানুষের কাছে দোয়া চাই। আমার একমাত্র ছেলেকে যেন ফিরে পাই।
তামজিদ হোসেন নামে এক অভিভাবক অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, আমার একমাত্র ভাগ্নি, কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে তার কান্না দেখে। মুখম-লসহ শরীরের অনেক অংশ ঝলসে গেছে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। এসি রুমের মধ্যে আছে, তবু বলছে মা বাতাস করো, মামা বাতাস করো। ওরে কখনো কিচেন রুমে যেতে দিতাম না আগুনের তাপ লাগবে বলে আর আজকে সে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে মেয়েটা।
১১ জনের ডিএনএ সংগ্রহ: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখনো শনাক্ত না হওয়া ছয় মরদেহের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ১১ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেছে সংস্থাটির ফরেনসিক বিভাগ। সিআইডি বলছে, মরদেহগুলো যেহেতু শিশুর, তাই শনাক্তের জন্য কেবল বাবা-মার ডিএনএ নমুনাই যথেষ্ট হবে।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) শম্পা ইয়াসমিন বলেন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) থাকা ৬টি মরদেহ এবং মাংসপি- থেকে ১১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বিপরীতে সিআইডিতে এসে এখন পর্যন্ত ১১ জন দাবিদার তাদের রক্তের নমুনা দিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে এক পরিবারের তিনজন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। যা থেকে মিলিয়ে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, বুধবার সকাল থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত ১১ জন বাবা-মার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি কারো সন্তান বা স্বজন নিখোঁজ থাকেন এবং তাদের নাম এখনো সরকারি তালিকায় না থাকে, তাহলে মালিবাগে সিআইডি অফিসে গিয়ে ডিএনএ নমুনা দেবেন। সেই সঙ্গে শুধু বাবা-মার নমুনা দেওয়া অনুরোধ জানান সিআইডি।
এদিকে এ ঘটনায় নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের মালিবাগে সিআইডি ভবনে ডিএনএ ম্যাচিংয়ের জন্য নমুনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। বুধবার সরকারি তথ্য বিবরণী থেকে এই অনুরোধ জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের প্রকাশিত তালিকায় যাদের সন্তান বা স্বজনের নাম নেই, সেসব পরিবারের সদস্যদের মালিবাগে সিআইডি ভবনে ডিএনএ ম্যাচিংয়ের জন্য নমুনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান গতকাল এ অনুরোধ জানিয়েছেন।
এতে আরও বলা হয়, সিএমএইচের মর্গে রাখা ছয়টি মৃতদেহ এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে মৃতদেহসমূহের ডিএনএ এনালাইসিসের (প্রোফাইলিং) জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যা সিআইডির ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ প্রোফাইলিং করা হবে। নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের নমুনা পাওয়া গেলে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ডিএনএ ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে।
৮ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন, গুরুতর ১৩ জন: জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিচালক নাসির উদ্দীন বলেছেন, সিঙ্গাপুরের একজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে আজ (গতকাল) আমরা বসেছি। বৈঠকে রোগীদের অবস্থা পর্যালোচনা করে ৩টি ভাগ করেছি। এখানে ক্রিটিক্যাল ক্যাটাগরিতে (সংকটাপন্ন) ৮ জন রোগী আছে। তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তাদের অবস্থা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হচ্ছে। তাদের বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে (গুরুতর) আছে ১৩ জন রোগী। ইন্টারমেডিয়েট ক্যাটাগরিতে আছে ২৩ রোগী। তাদের দ্রুত ভালোর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সব মিলে মোট ৪৪ জন রোগী এখানে ভর্তি আছে।
পরিচালক বলেন, রোগীদের এই ৩ ক্যাটাগরি আমাদের ডায়নামিক প্রসেস। রোগীদের অবস্থাভেদে এসব ক্যাটাগরি পরিবর্তন হতে পারে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এই ক্যাটাগরি করা হয়েছে। আমাদের এখানকার প্রত্যেক রোগী নিয়ে আজ আলোচনা করেছি। কারো অপারেশন লাগবে কি না, কার কি পরিমাণ ড্রেসিং লাগবে, ওষুধ পরিবর্তন হবে কি না; সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধি কতদিন থাকবে, এটা এখনো ঠিক হয়নি। তারা কতদিন থাকতে চায়। সেটা পরবর্তীতে জানাব।
তিনি আরও বলেন, সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রায় বেশকিছু জায়গায় তিনি আমাদের সঙ্গে একমত। কিছু বিষয়ে তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। আমেরিকাও আমাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছে। সবার পরামর্শ নেওয়া হবে। এই মুহূর্তে দগ্ধদের বিদেশ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। এখানে যে প্রটোকলে আছে সেটাই ফলো করা হবে বলে জানান জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক নাসির উদ্দীন।
বার্নে কড়াকড়ি, প্রবেশেও ছিল নিষেধাজ্ঞা: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রুত নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এরপর থেকেই সেখানে উপচেপড়া ভিড় লেগেই ছিল। তবে গতকাল বুধবার সকালে বার্ন ইনস্টিটিউটের পুরো এলাকার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছিল না উৎসুক জনতার ভিড়। শুধু বিমানে বিধ্বস্ত হতাহতদের স্বজন আর অন্যান্য রোগীদের আত্মীয়-পরিজনদের, চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের দেখা গেছে।
সকালে ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রবেশদ্বারে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন গেটে আনসার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা কঠোর নজরদারিতে দায়িত্ব পালন করছেন। গণমাধ্যমকর্মীদেরও গতকাল নিচে কিংবা ভেতরে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। অতিরিক্ত কোলাহল ও জনসমাগম এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের খোঁজে স্কুলে অভিযোগ করার অনুরোধ: বিমান দুর্ঘটনায় নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের সন্ধানে অভিভাবকদের স্কুলে এসে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল দুপুরে এ তথ্য জানান মাইলস্টোন গ্রুপের পরিচালক ও ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রাসেল তালুকদার। তিনি বলেন, এইচএসসি পরীক্ষাথীদের কার্যক্রম সচল রাখা হয়েছে। তবে অন্য সব ক্লাসের কার্যক্রম কবে শুরু হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। বুধবার বিমান দুর্ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করেছে। কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে খুঁজে না পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫ নম্বর ভবনে অভিযোগ দায়ের করার অনুরোধ জানান তিনি।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                    -20251030020737.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                            -20251030233957.webp) 
        
        
        
       -20251030225605.webp) 
        
        
       -30-10-25-20251030222222.webp) 
        
        
        
        
        
       -20251030213733.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন