২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএকে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেয় সরকার।
এ ধরনের প্রকল্পগুলো বরাবরই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের আমলাদের মতপার্থক্যের কারণে চসিকের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরকে পাশ কাটিয়ে মেগা প্রকল্পটি হাতিয়ে নেয় সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম। সময়ের ব্যবধানে প্রকল্প ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে। কাজও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়।
তবে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি শেষ হয়নি চট্টগ্রাম নগরবাসীর। জলাবদ্ধতাবিহীন পরিচ্ছন্ন নগরীর স্বপ্ন দেখে চলতি বর্ষা মৌসুম শুরু করেছিল নগরবাসী। কিন্তু ভরা বর্ষায় সে স্বপ্ন প্রতিবারের মতোই তাদের দুঃস্বপ্নই উপহার দিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর মেয়র পরিবর্তন হয়েছে চসিকের। আদালতের আদেশে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন ডা. শাহাদাত হোসেন। সিডিএর চেয়ারেও বসেন প্রশাসক। চট্টগ্রামে নাগরিক সেবা প্রদানকারী গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠানের ‘কর্তা’ বদল হলেও চট্টলাবাসীর দুর্ভোগ কমেনি এক কড়িও।
অভিযোগ রয়েছে, এই প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে করা হয়নি সমীক্ষা। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গেও করা হয়নি কোনো ধরনের সমন্বয়। ফলে প্রকল্পের কাজ শুরু হলে চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, ট্রাফিক পুলিশসহ সরকারি নানা সংস্থার আপত্তির মুখে পড়ে বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী। যে কারণে ২০২০ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলে বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬-এর জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সমীক্ষা ছাড়া মেগা প্রকল্পে শুরুতেই গলদ ছিল প্রচুর। বর্তমানে নগরীতে ৫৭টি খাল থাকলেও প্রকল্পটিতে ৩৬টি খাল সংস্কার প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। যে কারণে খাল সংস্কার প্রকল্পে বাকি ২১টি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
সেই সঙ্গে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। ৩৬টি খালের মধ্যে নগরীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খালের মধ্যে ‘হিজড়া খাল’ হলেও সে খালেরই সংস্কার শুরু করেনি সিডিএ। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ের বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ে বহদ্দারহাট, চাক্তাই, বাকলিয়া ও চকবাজার এলাকার মানুষেরা।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান চার প্রকল্পের মধ্যে তিনটির আওতায় ৪০টি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া প্রকল্পভুক্ত ৩৬ খালের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ। সিডিএর দুই হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক অপর প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষ।
প্রকল্পের আওতায় জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত ১২টি খালের মুখে ১২টি রেগুলেটর নির্মাণ করার কথা সিডিএর। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ চলছে ১০টির। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় এ প্রকল্পের ধীরগতির কারণ।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে থইথই জলে ডুবেছে নগরীর অধিকাংশ এলাকা। ইতোমধ্যে পানি বেড়ে হাঁটুতে পৌঁছেছে। কোথাও কোথাও জল ছুঁয়েছে নগরবাসীর কোমর। নগরীর নিচু এলাকায় মানুষকে নৌকা চালাতে দেখা গেছে অনেক জায়গায়।
সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরের চকবাজার, বহদ্দারহাট, ষোলশহর, ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, শুলকবহর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, ডিসি সড়ক, পাঠানটুলী, কালামিয়া বাজার, বাকলিয়া, ছোটপুল, বড়পোল, আগ্রাবাদ বেপারি পাড়া, মহুরিপাড়া, সিডিএ আবাসিক, আতুরার ডিপো, চকবাজারসহ এলাকায়। বিভিন্ন এলাকার কোথাও গোড়ালি সমান, কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রামের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ইমরান হাসেম বলেন, গত রোববার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে ২১৩ মিলিমিটারের ওপর বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত (১০৮ মিলিমিটার) হয়েছে গত ২৮ জুলাই সোমবার।
দায় এড়িয়ে চসিকের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন এলাকার খালে কাজ চলমান থাকায় নালার পানি চলাচল বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টি ছাড়াও অনেক অলিগলিতে পানি জমে আছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ছয়টি রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংস্থার প্রতিটির নিজস্ব মাস্টারপ্লান রয়েছে। এসব সংস্থা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না থাকাতে মেগা প্রকল্পগুলো শতভাগ আলোর মুখ দেখছে না বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, হাজার কোটি টাকার বুলি আউড়ালেই কি জল নামবে? টাকা খরচ করার আগে কোথায় সমস্যা তা খুঁজে বের করতে হবে। যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতার চেয়ে সমন্বয়হীনতাই চট্টগ্রামের বড় সমস্যা।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকল্পগুলো নিয়েছেন।
অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে প্রকল্পের কিছু কাজ থেমে থেমে আছে জানিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) কাজি হাসান বিন সামস বলেন, বর্ধিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে (জুন-২০২৬)। নগরীর খালগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে। খালগুলো পরিষ্কার না থাকার কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে নামতে পারছে না।