দক্ষিণ পেরুর শুকনো, নির্জন মরুভূমির উপর দিয়ে যখন কোনো বিমান উড়ে যায়, তখন এক অলৌকিক দৃশ্য ধরা দেয় পাইলটের চোখে। নীচের ধূসর পাথর আর লালচে বালুর মাঝখানে হঠাৎ করেই জেগে ওঠে কয়েকটি বিশাল সাদা রেখা- কখনো সরল, কখনো ত্রিভুজ, কখনো ঘূর্ণায়মান। ধীরে ধীরে সেই রেখাগুলোর মাঝে ফুটে ওঠে এক হামিংবার্ড, এক মাকড়সা, এক বানরের অবয়ব। এই বিস্ময়কর দৃশ্যই হলো নাসকা লাইন, যা আজও প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ এবং সাধারণ মানুষের জন্য এক অসীম রহস্যের উৎস।
পৃথিবীর এই ব্যতিক্রমী ভূচিত্র পেরুর নাসকা শহরের কাছাকাছি, লিমা থেকে মাত্র ২০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। মরুভূমির বুক চিরে প্রায় ৩১০ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৮০০টি সোজা রেখা, ৩০০টি জ্যামিতিক নকশা এবং ৭০টি প্রাণী ও উদ্ভিদের চিত্র। এদের মধ্যে কিছু রেখা এতটাই বিশাল যে ৩০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত, আবার কিছু জৈবরূপের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১২০০ ফুট- যা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের সমান।
আকাশ থেকে আবিষ্কার
যদিও নাসকা লাইন স্থানীয় জনগণের পরিচিত ছিল বহু বছর ধরেই, কিন্তু এগুলোর প্রকৃত গুরুত্ব আবিষ্কৃত হয় বিশ শতকের শুরুতে, যখন পেরুর ওপর দিয়ে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল শুরু হয়। পাইলটরাই প্রথম আকাশ থেকে দেখতে পান এই বিশাল, জ্যামিতিক ও প্রতীকধর্মী রেখাগুলোর বিস্তার।
এর আগে ১৯২৬ সালে পেরুর প্রত্নতত্ত্ববিদ টোরিবিও মেজিয়া জেসপে এগুলোর প্রাথমিক গবেষণা করেন, কিন্তু ভূমি থেকে দেখা সম্ভব না হওয়ায় সেগুলোর প্রকৃত রূপ আবিষ্কৃত হয়নি। ১৯৪১ সালে আমেরিকান অধ্যাপক পল কোসোক একটি রেখার মুখোমুখি হন এবং লক্ষ্য করেন, সূর্যাস্তের সময় সেটি ঠিক সূর্যের সঙ্গে সারিবদ্ধ। সেই অভিজ্ঞতা তাকে বিশ্বাস করায়, এই রেখাগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং তিনি একে ‘বিশ্বের বৃহত্তম জ্যোতির্বিদ্যার বই’ হিসেবে অভিহিত করেন।
রেইতিতে রাইখ
নাসকা রেখাগুলোর রক্ষক হিসেবে ইতিহাসে একটি নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়- মারিয়া রাইখ। এই জার্মান গণিতবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রায় ৪০ বছর ধরে একা এই রহস্যময় রেখাগুলোর বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণে কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রেখাগুলোর পেছনে রয়েছে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ক্যালেন্ডারিক উদ্দেশ্য। তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মরুভূমির প্রান্তে একটি ছোট ঘরে কাটিয়েছেন, যেন নিজেই প্রহরী হয়ে এগুলোকে রক্ষা করতে পারেন বেপরোয়া পর্যটকদের হাত থেকে।
রাইখের এই একনিষ্ঠতা বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করে। ১৯৭৪ সালে তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনুদান লাভ করেন, এবং তার গবেষণা এই রেখাগুলোর প্রতি নতুনভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে বৈজ্ঞানিক মহলে।
কীভাবে তৈরি হলো এই রেখা?
নাসকা লাইন তৈরি হয়েছে একটি বিস্ময়করভাবে সহজ কিন্তু কার্যকর পদ্ধতিতে। মরুভূমিতে ছড়িয়ে থাকা গাঢ় লালচে পাথরগুলো সরিয়ে ফেলা হলে নিচে বেরিয়ে আসে হালকা রঙের বালু। এই বালুর উপর দিয়েই আঁকা হয় রেখাগুলো। কোনো রঙ ব্যবহার হয়নি, কোনো খননও নয়- শুধু উপরের স্তর সরিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে উচ্চ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ এই চিত্রমালা। অঞ্চলটি এতটাই শুষ্ক এবং প্রাকৃতিক ক্ষয় এত কম যে রেখাগুলো শত শত বছর পরেও টিকে রয়েছে প্রায় অবিকৃতভাবে।
নাসকা লাইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে গবেষকরা একমত নন। প্রথম তত্ত্ব অনুযায়ী, এগুলো জ্যোতির্বিদ্যাগত কার্যকলাপের অংশ ছিল- সূর্য, চাঁদ বা নক্ষত্রের গতিপথ নির্ধারণের জন্য ব্যবহার হতো। পল কোসোক ও মারিয়া রাইখ এই তত্ত্বের প্রবক্তা।
তবে ১৯৭০-এর দশকে এই ধারণা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার জোহান রেইনহার্ড রেখাগুলোর বিশ্লেষণে আনেন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তার মতে, নাসকা অঞ্চলের চরম খরা ও পানির সংকটকে কেন্দ্র করে এই রেখাগুলো তৈরি হয়েছিল। এগুলো এমন স্থান বা দিক নির্দেশ করে যেখানে পানির জন্য দেবতার উদ্দেশ্যে আচার-অনুষ্ঠান করা হতো। তার গবেষণায় দেখা যায়, অনেক রেখা কোনো জ্যোতির্বিদ্যা নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত হন গবেষক অ্যান্থনি আভেনি। তিনি বলেন, রেখাগুলো জল খোঁজার যন্ত্র নয়, বরং জল পাওয়ার জন্য প্রার্থনার ক্ষেত্র। বিশেষ করে ট্র্যাপিজয়েডগুলো এমনভাবে তৈরি, যেন মানুষ তাতে ঢুকে হাঁটতে পারে- একটি প্রতীকী ধর্মীয় যাত্রার অংশ হিসেবে।
এছাড়াও অনেক রেখায় আঁকা প্রাণীর প্রতীকবাদের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। যেমন, মাকড়সাকে ধরা হয় বৃষ্টির প্রতীক হিসেবে, হামিংবার্ড উর্বরতার প্রতীক, আর বানর আসলে আমাজনের প্রতিনিধিত্ব করে- একটি জলের এলাকা। এসব চিহ্ন হয়তো ছিল প্রাচীন পেরুর ধর্ম, প্রকৃতি ও বিশ্বাসের এক বহির্প্রকাশ।
এক অলিখিত বার্তা?
প্রত্নতত্ত্ববিদ রেইনহার্ড বলেন, ‘কোনো একটি তত্ত্বই নাসকা লাইনকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, প্রতীকবিদ্যা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে আমরা কাছাকাছি যেতে পারি সত্যের।’
আজ, ড্রোন প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ইমেজিং, এবং জিও-ফিজিক্যাল অ্যানালাইসিসের সাহায্যে প্রতিনিয়ত খুঁজে বের করা হচ্ছে নতুন রেখা, নতুন প্যাটার্ন, নতুন তত্ত্ব।