বিশ্বজুড়ে শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চ সম্মানিত ও পবিত্র পেশাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষকদের ভূমিকা শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ নয়- তারা একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ইতিহাসে এমন কিছু শিক্ষক আছেন, যাদের অবদান আমাদের সমাজ, শিক্ষা এবং সভ্যতায় স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
চলুন, জেনে নেই এমন ৮ জন শিক্ষকের কথা, যারা বিশ্ব ইতিহাসে শিক্ষকতায় অনন্য অবদান রেখেছেন।
১. অ্যান সুলিভান
অ্যান সুলিভান ছিলেন এক সংগ্রামী শিক্ষিকা যিনি দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরও নিজের সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে অন্যের জীবন বদলে দিয়েছিলেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্রী ছিলেন হেলেন কেলার- একজন দৃষ্টি, শ্রবণ এবং বাকশক্তিহীন শিশু। অ্যান সুলিভানের সহানুভূতিশীল এবং উদ্ভাবনী শিক্ষাদান পদ্ধতির ফলে হেলেন কেলার ইতিহাসের প্রথম দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করেন। অ্যান সুলিভান আজও স্মরণীয়, কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন- একজন শিক্ষক একটি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
২. অ্যারিস্টটল
‘প্রথম শিক্ষক’ হিসেবে বিশ্ব খ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল শুধুমাত্র দর্শনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং শিক্ষার উন্নয়নেও অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এথেন্সে ‘লাইসিয়াম’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে শিক্ষাকে বিজ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে সাজিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘যারা শিশুদের ভালোভাবে শিক্ষিত করে, তারা তাদের জন্মদাতার চেয়েও বেশি সম্মানিত- কারণ তারা কেবল জীবন দেয় না, জীবনের সঠিক পথও দেখায়।’ এই উক্তি শিক্ষার মর্যাদা ও শিক্ষকের ভূমিকাকে অসাধারণভাবে তুলে ধরে।
৩. মারিয়া মন্টেসরি
ইতালির প্রথম মহিলা চিকিৎসকদের একজন মারিয়া মন্টেসরি ছোট শিশুদের শেখার প্রক্রিয়ায় বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি নিয়ে আসেন। শিশুদের স্বাধীনতা, অনুসন্ধানী মন ও হাতে-কলমে শেখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘মন্টেসরি পদ্ধতি’। আজও তার এই পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে প্রি-স্কুল ও প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
৪. ফ্রিডরিখ ফ্রোবেল
‘কিন্ডারগার্টেন’ শব্দটির জনক ফ্রিডরিখ ফ্রোবেল। যিনি ‘শিশুদের শিক্ষা শুরু হোক ভালোবাসা, স্বাধীনতা ও আত্ম-উন্মোচনের মাধ্যমে’- এই দর্শন প্রচার করেছিলেন। ফ্রিডরিখ বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা এমনভাবে হওয়া উচিত যেন শিশুর ভেতরের প্রতিভা বিকশিত হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত থেকে।
৫. জেইম এসকালান্টে
বলিভিয়া থেকে আসা গণিত শিক্ষক জেইম এসকালান্টে প্রমাণ করেছিলেন, একজন শিক্ষক চাইলে যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও শিক্ষার্থীদের সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারেন। লস অ্যাঞ্জেলসের একটি সমস্যাক্রান্ত স্কুলে গণিত পড়িয়ে তিনি ৩০ জন শিক্ষার্থীকে এপি ক্যালকুলাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করান- যা আমেরিকায় তখন এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। তার জীবনী অবলম্বনে ‘স্ট্যান্ড অ্যান্ড ডেলিভারি’ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
৬. সাবিত্রীবাই ফুলে
ভারতের প্রথম নারী শিক্ষিকা সাবিত্রীবাই ফুলে, যিনি জাতপাত ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নারীদের শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। স্বামী জ্যোতিরাও ফুলের সহায়তায় তিনি ১৮টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমাজে নারী ও দলিত শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন। তিনিই ছিলেন নারী শিক্ষার অগ্রদূত ও সমাজ পরিবর্তনের মূর্ত প্রতীক।
৭. এমা হার্ট উইলার্ড
১৯ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুব সীমিত ছিল। এমা হার্ট উইলার্ড নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন এবং ট্রয় উইম্যান’স সেমিনারি প্রতিষ্ঠা করেন- যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় তার অবদান আজও অনন্য।
৮. মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক
তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক শিক্ষাকে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রবর্তন করেন, ল্যাটিন বর্ণমালার প্রবর্তন করেন, এবং দেশের সর্বত্র সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ‘জাতির স্কুল’ চালু করেন। ১৯২৮ সালের ২৪ নভেম্বর তাকে ‘প্রধান শিক্ষক’ উপাধি দেওয়া হয় এবং দিনটি আজও তুরস্কে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।