মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সেলিম আহমেদ ও এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

বৈষম্য দূর হয়নি, ফিরেছে ভিন্নভাবে

সেলিম আহমেদ ও এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নিয়ে গত বছর দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নেমেছিলেন রাজপথে। বিন্দু বিন্দু ঘটনাপ্রবাহ থেকে যা একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। আওয়ামী শাসনের সাড়ে পনেরো বছরের দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে পথে নামে আপামর জনতা এভাবেই একটি দাবি থেকে দানা বাঁধা আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের মতো সামষ্টিক পরিসর লাভ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বৈষম্য দূর করতে হাজারো তরুণ প্রাণ দিয়েছে, চির পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছে তার ফলাফল কী, বৈষম্য কি আদৌ দূর হয়েছে? অন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও সমাজচিন্তকদের মতে, বৈষম্য দূর হয়নি বরং ভিন্নভাবে ফিরেছে।

‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা ফিরেছে ঠিকই; কিন্তু জীবনের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে। আগের মতো গুম-খুন না হলেও ছিনতাই, ধর্ষণ, প্রকাশ্য চাঁদাবাজি মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যেক স্থানে আগের মতোই বিরাজ করছেন দুর্নীতিগ্রস্তরা। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়াচ্ছেন। এটা আন্দোলনের আকাক্সক্ষা ছিল না কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মাকসুদ হক।

তার সুরে একই কথা বলেছেন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাতিশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু কোটার বিরুদ্ধে নয়, বৈষম্যের বিরুদ্ধেও হয়েছিল। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক জায়গায় এখনো বৈষম্য রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বছরের মাথায় সব সংকট দূর করতে পারবে না, এটা চরম সত্য। তবে বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা আশানুরূপ নয়। কিছু বৈষম্য দূর হলেও ঘুরেফিরে অনেক বৈষম্য ফের সামনে এসেছে। আমাদের নতুন বাংলাদেশের এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডে কথা হলে বেসরকারি চাকরিজীবী নুরুল হকও বললেন একই কথা। তার ভাষ্য, ‘জুলাই আন্দোলন যে বৈষম্য দূরের জন্য হয়েছিল সেটি হয়নি। বরং এক বছরের মাথায় এসে রাজনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরÑ সব ক্ষেত্রেই কোটা বা বৈষম্যের অবস্থান পাওয়া যাচ্ছে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ব্যাপারটা হতাশার বটে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্য কমেনি, বরং তা আরও বেড়েছে, যা ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জুলাইকে ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজনীতি, দুর্নীতি, চাকরি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়গুলো বন্ধ হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ বেড়েছে।

তারা আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় নানা কাঠামোতে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার এখনো হয়নি। দেশকে গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণে সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা প্রচলন সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া নানা কারণে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সামাজিক বৈষম্য নিরসনে সরকারকে খুব একটা চাপে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্তব্য তাদের। 

২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ পদই কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। শুধু সরকারি চাকরি নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের ছিল নানা বৈষম্য। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মী কিংবা অনুসারীরাই সরকারি ও বেসরকারি সেবায় পেতেন প্রাধান্য। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের অজুহাতে অনেক মেধাবীকে সরকারি চাকরিতে উত্তীর্ণ হলেও নিয়োগ দেওয়া হতো না। ওই বছর বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনের মুখে সব কোটা বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপর এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ মে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য থাকা ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত। এই রায়ের পর ফের কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তবে ওই আন্দোলন শুধু কোটা নয়; সমাজ ও রাষ্ট্রে চলমান অন্যান্য বৈষম্যের বিরুদ্ধেও ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ ছাত্রদের পাশাপাশি রাস্তায় নামেন সাধারণ জনতাও। 

‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ এই স্লোগানে ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। সেই আন্দোলনে এক বছরের মাথায় এসে বৈষম্য কতটা দূর হলো, সেই প্রশ্ন এখন এসেছে সবার মাঝে। রাজনৈতিক একই পট পরিবর্তনে দেশের আপামর মানুষ খুশি হলেও অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোতে দৃশ্যমান পরিবর্তন না আসায় হতাশ অনেকেই। জুলাই অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিলেন এমন অনেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন রাজনীতি থেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করেছেন শতাধিক ছাত্র-জনতা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলেন, বিগত ৫ দশকের বেশি সময় ধরে সব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাদের সুযোগ দেওয়া হোক সেটা সবাই চায়। তবে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হোক সেটা কেউ চায়নি। সুযোগ-সুবিধার একটা সীমানা থাকা দরকার ছিল। এ ছাড়া যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাদের অনুসারীরাও অনেক সুবিধা পেয়েছেন। বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বিরোধি মতের লোকজন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার আগে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পুলিশ ভ্যারিফিকেশন করা হতো। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন কিন্তু আওয়ামী লীগবিরোধী প্রমাণ পেলেই যোগদান করতে দেওয়া হতো না। 

বিশেষ করে বিগত দেড় যুগের বেশি সয়ম বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী মতের লোকজন অনেক নিপীড়িত হয়েছে। সরকারি সেবা, চিন্তা, শিক্ষায়ও সাধারণ মানুষ ছিল বঞ্চিত। তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পর সেই ধারা থেকে কিছু বের হয়ে এসেছে। আইনি, পুলিশি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা পেতে মানুষের হয়রানি কিছু কমেছে। তবে জুলাই যোদ্ধাদের দেওয়া হচ্ছে নানা সুযোগ-সবিধা। চিকিৎসা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে ভর্তি, ব্যাংক লোন, কর্মসংস্থানসহ নানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জুলাই যোদ্ধাদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা, সরকারি চাকরিতে কোটা এবং শহিদদের ফ্ল্যাট দেওয়ার চিন্তা করা হলেও সমালোচনার মুখে তা থেকে সরে এসেছে সরকার। অন্যদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মতো অনেকে ভুয়া জুলাইযোদ্ধা সেজে করছেন সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার। বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে তদবির বাণিজ্য থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি-দখলবাজিতে জড়িয়েছেন অনেক কথিত জুলাই যোদ্ধা। কেউ কেউ মব সৃষ্টি করেও চাঁদাবাজি করছেন। তারা জুলাইকে টাকা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। 

গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, বাস্তবে সেখানে অনেক ফারাক দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদের পতনের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় হয়। ইউনূস সরকারের প্রতি মানুষের অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল। মানুষ গণতন্ত্রে উত্তরণে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কারের বিষয়গুলোও এখনো স্পষ্ট হয়নি। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সরকারকে যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল, সেটি যথেষ্ট হয়নি। ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন ঘটলেও কর্তৃত্ববাদের দোসরদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়নি। দোসরদের অনেককে ক্ষমতা কাঠামোতে আনা হয়েছে, এরা সরকারকে সফল হতে দিচ্ছে না।’

সামাজিক বৈষম্য নিরসনে সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনও বৈষম্য নিরসনে সরকারকে যথেষ্ট চাপে রাখতে পারেনি। এনসিপির নেতারা কাদা ছোড়াছুড়ি, সহিংসতা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না হলে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে থেকেও বৈষম্য নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, জুলাই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় মানুষের মনে অনেক প্রত্যাশা ছিল। মানুষের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল অত্যাচার, দুর্নীতি থেকে মুক্তি। নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ আর বৈষম্যহীন একটি সমাজ। বিগত এক বছরে সরকারের শাসনব্যবস্থা এসব গণপ্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না।

Shera Lather
Link copied!