- রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা হিসেবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত
- গণঅভ্যুত্থানে শহিদেরা জাতীয় বীর, পরিবার পাবে আইনি সুরক্ষা
- স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা
- গণঅভ্যুত্থানের বিজয় এখন রাষ্ট্রীয় নীতির দিকনির্দেশনা
- ইতিহাসে স্থান পেল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’
- নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা, জাতির সামনে ঐতিহাসিক দলিল
- ছাত্র-জনতার রক্তে লেখা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ ও রাজনৈতিক পালাবদলের দিন ৫ আগস্ট। এই দিনে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং সর্বস্তরের জনগণের গণআন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতি পেয়েছে নতুন প্রত্যয়ের অভিব্যক্তিÑ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতা, জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আত্মত্যাগ, শোষণবিরোধী লড়াই এবং বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের দাবি, যা আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার নতুন সংবিধানে চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির এই ঘোষণাপত্রকে তপশিলভুক্ত করবে বলেও বলা হয়েছে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গতকাল রাজধানী ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে উপস্থাপিত হলো ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। এই ঘোষণাপত্রে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, গণআকাক্সক্ষা, গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের রূপরেখা এক বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে তিনি জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠান মঞ্চে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ শুরু করেন প্রধান উপদেষ্টা। এর আগে বিকেল ৫টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌঁছেছেন তিনি। এরপর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন।
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হলো ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের একটি দলিল। জানা গেছে, বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে এটি চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব শহিদকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহিদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
ঘোষণাপত্রের প্রথমাংশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে ২৩ বছর ধরে বঞ্চিত এই ভূখ-ের মানুষ রুখে দাঁড়ায় এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের পরও জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থতা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের একদলীয় বাকশাল কায়েমের পরিণতি হিসেবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এর পরের দশকে সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের ধারাও চিহ্নিত করা হয়।
ঘোষণাপত্রে অভিযোগ করা হয়, ২০০৭ সালের ১/১১ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র শাসনের পথ তৈরি হয়। বিগত ১৬ বছর ধরে চলা এই ফ্যাসিবাদী ও গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা সংবিধানের অবৈধ পরিবর্তনের মাধ্যমে একদলীয় শাসনের কাঠামো তৈরি করে বলে দাবি করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার অভিযোগ উত্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টা।
ঘোষণাপত্রে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার প্রহসনের নির্বাচন করেছে এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে। সরকারি চাকরিতে দলীয় নিয়োগ, কোটাভিত্তিক বৈষম্য ও শিক্ষার্থীদের প্রতি নিপীড়নকে ছাত্র-জনতার ক্ষোভের অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে চালানো দমন-পীড়নের ফলেই সারা দেশে দল-মতনির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ শুরু হয়, যা রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত হয়। ঘোষণাপত্রে দাবি করা হয়, এই আন্দোলনে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বাহিনী নারী-শিশুসহ প্রায় ১ হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পরিস্থিতির চূড়ান্ত পর্বে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জনগণের পক্ষে অবস্থান নেন এবং ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। এরপর অবৈধভাবে নির্বাচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের আলোকে তার (ড. মুহাম্মদ ইউনূসের) নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে জনগণের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রে পরবর্তী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় এবং জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সংস্কার, আইনের শাসন, মানবাধিকারের সুরক্ষা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বলে ঘোষণাপত্রে বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিশেষভাবে ঘোষণা করা হয়, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকালীন গুম, খুন, হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও রাষ্ট্রীয় লুণ্ঠনের ঘটনার দ্রুত বিচার হবে এবং সব শহিদকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হবে। আহত, নিপীড়িত ছাত্র-জনতা ও আন্দোলনকারীদের জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার নতুন সংবিধানে এই ঘোষণাপত্রকে তপশিলভুক্ত করবে এবং পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে।
এই ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গণ্য হয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতন অধ্যায় সূচিত করল। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই ঘোষণাপত্র যেমন ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের সাক্ষ্য দেয়, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখাও প্রদান করে।